ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

অপ্রাপ্ত বয়সেই ৩ বিয়ে, সংবাদ করায় ৪ সাংবাদিকের নামে মামলা

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৪
অপ্রাপ্ত বয়সেই ৩ বিয়ে, সংবাদ করায় ৪ সাংবাদিকের নামে মামলা

লালমনিরহাট: বাল্যবিয়ে মুক্ত জেলা লালমনিরহাটে অপ্রাপ্ত এক ছেলের তিন বিয়ের ঘটনায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করায় চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইবুনালে মামলার আবেদন করেছেন নিকাহ রেজিস্ট্রার।

রংপুর আদালতে সাইবার ট্রাইবুনালে মামলার আবেদন করেছেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজী ওমর আলী।

তিনি আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ছাবেরা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক।

অপ্রাপ্ত বয়স্ক রাজু মিয়া আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের গন্ধমরুয়া গ্রামের আউয়াল মিয়ার ছেলে। তার জন্ম সনদ (১৫/১২/২০০৩) অনুযায়ী বয়স ২০ বছর অতিক্রম হলেও সরকারি বিধিমতে ২১ বছরের আগে বিয়ের সুযোগ নেই। অথচ ২০ বছরেই তিন বিয়ে ও দুটি বিবাহ বিচ্ছেদ করেছেন তিনি।

সাইবার ট্রাইবুনালে দায়ের করা অভিযোগের অভিযুক্ত সংবাদকর্মীরা হলেন- বিজনেস বাংলাদেশের লালমনিরহাট প্রতিনিধি আশরাফুল হক, এশিয়ান টিভি ও জবাবদিহি পত্রিকার নিয়ন দুলাল, দৈনিক নবচেতনার লিয়াকত আলী ও দৈনিক লাখকণ্ঠের আব্দুর রাজ্জাক।

সদর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক বলেন, আদালতের নির্দেশে অভিযোগটি তদন্ত চলছে। তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

জানা গেছে, আদিতমারী উপজেলার গন্ধমরুয়া গ্রামের আউয়াল মিয়ার ছেলে রাজু মিয়া দুই বছর আগে প্রায় ১৮ বছর বয়সে মোগলহাট ইউনিয়নের ভাটিবাড়ি গ্রামের ফজলু হকের কিশোরী মেয়ে ফারজানাকে বিয়ে করেন। বর কনে দুজনের বয়স কম থাকায় বিশেষ রেজিস্ট্রি হলেও নকল দেননি পার্শ্ববর্তী মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজী ওমর আলী। বিয়ের এক মাসের মধ্যে তাদের সংসারে বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠে। নকল না থাকায় আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেননি মেয়ের পরিবার। অবশেষে বিয়ের এক বছরের মধ্যে একই নিকাহ রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাদের।

বিচ্ছেদের পরে একইভাবে দুর্গাপুর গ্রামের আমিনুল হকের মেয়ে স্থানীয় ছাবেরা খাতুন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রুপালী খাতুনকে (১৩) দ্বিতীয় বিয়ে করেন রাজু মিয়া। দ্বিতীয় বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন রুপালীর স্কুলের মৌলভি শিক্ষক মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজী ওমর আলী। বর, কনে দুজনে অপ্রাপ্ত হওয়ায় নকল দেননি কাজী ওমর আলী। সেই বিয়েতেও এক মাস পরে বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠে। আবারও সমস্যায় পড়েন বর ও কনের পরিবার। নকল না দেওয়ায় কোনো পক্ষ নিতে পারছিলেন না আইনি পদক্ষেপ।

অবশেষে রাজু মিয়া রুপালীকে বিয়ে করেছেন মর্মে লিখিত দিয়ে গত বছরের ২৪ নভেম্বর তাদের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটান। তবে এ বিচ্ছেদের নোটিশ ফেরত পাঠান রুপালীর পরিবার। রাজুর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিয়ের নকল চেয়ে দফায় দফায় নিকাহ রেজিস্ট্রার ওমর আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন রুপালীর পরিবার। এদিকে রাজু পুনরায় প্রথম স্ত্রীকে তৃতীয় বিয়ে করে ঢাকায় পাড়ি জমান।

বারবার নাবালক ছেলের বাল্যবিয়ে দিয়ে ফিস আদায় করলেও নকল না দেওয়ায় আলোচনায় আসেন কাজী ওমর আলী। একইসঙ্গে নিজে শিক্ষক হয়ে তার বিদ্যালয়ের নাবালিকা শিক্ষার্থীর বিয়ে দিয়ে বৈধ কাগজ না দেওয়ার প্রতারণার বিষয়টি অনুসন্ধানে নামেন চার জন সংবাদকর্মী। পরে রুপালীর পরিবারের সব সদস্য, বিয়ের সাক্ষী ঘটকসহ সংশ্লিষ্টদের ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।

গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা রেজিস্ট্রার লিখিত কৈফিয়ত তলব করে মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিটার কাজী ওমর আলীকে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গত ১৫ জানুয়ারি চার সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে রংপুর সাইবার ট্রাইবুনালে মামলার আবেদন করেন কাজী ওমর আলী। পরে বিচারক অভিযোগটি তদন্ত করতে লালমনিরহাট সদর থানাকে দায়িত্ব প্রদান করেছেন।

অভিযুক্ত সাংবাদিক আশরাফুল হক বলেন, বাল্যবিয়ের শিকার কিশোরীর পরিবার বিয়ের নকল না পেয়ে ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছে এমন অভিযোগে ভিক্টিম, তার পরিবার ও বিয়ের সংশ্লিষ্ট সবার ভিডিও সাক্ষাৎকার ও প্রমাণিক কিছু দলিল সংগ্রহ করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের জন্য এবং গণমাধ্যমকে সংকুচিত করতে মিথ্যে মামলার আবেদন করেছেন নিকাহ রেজিস্ট্রার। যা আইনিভাবে মোকাবেলা করা হবে।

মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার ও ছাবেরা খাতুন উচ্চবিদ্যালয়ের মৌলভি শিক্ষক কাজী ওমর আলী বলেন, রাজুর আগের বিয়ে এবং তার বিচ্ছেদও আমার মাধ্যমে হয়েছে। তবে রুপালীর সঙ্গে রাজুর দ্বিতীয় বিয়ে আমি রেজিস্ট্রি করিনি।  

রাজুর প্রথম বিয়ের বর, কনে অপ্রাপ্ত থাকলেও সে বাল্যবিয়ে কীভাবে দিলেন এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তিনি।  

রাজুর দ্বিতীয় স্ত্রী রুপালি বলেন, আমার স্কুলের মৌলভি স্যার ওমর আলী আমাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করেছেন এবং বিয়ে পড়িয়েছেন। কিন্তু নকল দেননি।

ছাবেরা খাতুন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাধব চন্দ্র সাহা বলেন, বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক ওমর আলী নিকাহ রেজিস্টার কাজের জন্য বিদ্যালয় থেকে কোনো ধরনের অনুমতি নেয়নি। আর আমার বিদ্যালয়ের নাবালিকা শিক্ষার্থীর বিয়ের ঘটনাটি গণমাধ্যমে জেনেছি।

বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সভাপতি সিরাজুল হক বলেন, আমরা বাল্যবিয়েকে লাল কার্ড দেখাতে প্রায় সমাবেশ করে থাকি। সেখানে বাল্যবিয়ের কুফল নিয়ে বক্তব্য দেন মৌলভী শিক্ষক কাজী ওমর আলী। তিনি যদি বাল্যবিয়ে রেজিস্ট্রি করেন তবে তা দুঃখজনক। আমরা তার বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেব।

জেলা রেজিস্ট্রার খালিদ বিন আসাদ বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে প্রায় সমাবেশ করা হচ্ছে। নিকাহ রেজিস্টারদের অধিক্ষেত্রের বাহিরে এবং সহকারী রাখার কোনো নিয়ম নেই। মেয়ের ১৮ এবং ছেলের ২১ বছরের আগে বিয়ে আইনত অপরাধ। বাল্যবিয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্তসহ অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।