ঢাকা, মঙ্গলবার, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২১ মে ২০২৪, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

৩ কারণে শিডিউল বিপর্যয়ের ফাঁদে পশ্চিমাঞ্চল, সমাধান খুঁজছে রেলওয়ে

নিশাত বিজয়, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৬ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২৪
৩ কারণে শিডিউল বিপর্যয়ের ফাঁদে পশ্চিমাঞ্চল, সমাধান খুঁজছে রেলওয়ে

ঢাকা: বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে দুর্ঘটনা একবার ঘটলে তার সমাধান হয় না সহজে। গত ২ থেকে ৯ মে, এক সপ্তাহে টানা তিন দুর্ঘটনার ফলে একদিকে শিডিউল জটিলতা অন্যদিকে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিতেও পড়েছে রেলওয়ে।

শুক্রবার(১০ মে) ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন দেখা যায়, টানা নবম দিনের মতো পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনগুলো দীর্ঘক্ষণ দেরি করে স্টেশন ছাড়ছে।  

রেল সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা থেকে প্রতিদিন পশ্চিমাঞ্চলে ২৩ টি ট্রেন চলে। এরমধ্যে ১৯ টি আন্তঃনগর, তিনটি কমিউটার ও একটি মেইল ট্রেন।  

এরমধ্যে ঢাকা-জয়দেবপুর হয়ে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু হয়ে ঈশ্বরদী যায় ১৯ টি ট্রেন ও ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যায় চারটি।  

পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়া বেনাপোল এক্সপ্রেস, মধুমতী এক্সপ্রেস, সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও নকশীকাঁথা এক্সপ্রেস ছাড়া ১৯ টি ট্রেনই আধা ঘণ্টা থেকে ৮ ঘণ্টা দেরিতে চলছে বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার শাহাদাত হোসেন।

যে তিন কারণে দেরিতে চলছে পশ্চিমাঞ্চল ট্রেন 

রেলওয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে, সাম্প্রতিক তিন দুর্ঘটনায় ট্রেনের শিডিউল জটিলতা বাড়লেও এর পেছনে আরও কারণ উঠে এসেছে।

ঢাকা থেকে প্রতিদিন পশ্চিমাঞ্চলে ২৩ ট্রেন চলে। ঢাকা থেকে জয়দেবপুর হয়ে ইশ্বরদী রুটে দৈনিক ১৯ জোড়া ট্রেন চললেও জয়দেবপুর-ইশ্বরদী রুট সিঙ্গেল লাইন। ফলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে শিডিউলের ন্যূনতম তারতম্য হলে তৈরি হয় দীর্ঘ জটের।  

জনবল সংকটে এ রুটের রেলস্টেশনগুলো চালু নেই ফলে ট্রেনগুলোকে পড়তে হয় দীর্ঘ ক্রসিংয়ে।  

ট্রেনের শিডিউল জটিলতার কারণ হিসেবে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম তালুকদার বলেন, দুর্ঘটনার জন্য হয়েছে তো বটেই। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেন দূরপাল্লায় যায়, সেখানে আমাদের অনেক স্টেশন বন্ধ আছে।  

স্টেশন বন্ধ থাকায় ট্রেন ক্রসিংয়ে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, নাটোর থেকে আব্দুলপুর যেতে লাগে আধা ঘণ্টা। সময় কোনোভাবে এদিক-সেদিক একটি ট্রেন গেলে অন্যটির আধাঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।  

এদিকে বঙ্গবন্ধু সেতু ট্রেন চলাচলে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় নতুন করে বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ৪.৮ কিলোমিটার রেললাইন পার হতে ট্রেনগুলোর প্রায় ২০ মিনিট সময় লেগে যায় আর নতুন সেতুর ক্রসিং তৈরির জন্যে প্রতিটি ট্রেনের আরও ২০ মিনিট লেগে যাচ্ছে। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু সেতু সিঙ্গেল লাইন হওয়ায় এ সময়ে অন্য ট্রেনকে স্টেশনে ৪০-৫০ মিনিট অপেক্ষা করতে হচ্ছে।  

একইসঙ্গে এ এলাকার স্টেশনগুলোতেও রয়েছে জনবল সংকট। বঙ্গবন্ধু রেলসেতু প্রকল্পের অদক্ষ জনবল দিয়ে স্টেশন পরিচালনা করতে গিয়ে আরও গত সপ্তাহে মুখোমুখি অবস্থায় চলে গিয়েছিল দুই ট্রেন। দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্যে রক্ষা পায় ট্রেন দুটি।  

বঙ্গবন্ধু সেতুতে কী সমস্যা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম বলেন, অবশ্যই সমস্যা, বঙ্গবন্ধু সেতুতে লাইন তৈরি হচ্ছে। দুটি লাইন দিয়ে কষ্ট করে ট্রেন চালানো হচ্ছে। আগে যেখানে সময় লাগতো ২০ মিনিট, এখন লাগছে ৪০ মিনিট।  

তৃতীয় ও বৃহৎ যে সমস্যার কারণে শিডিউল জটিলতায় পড়তে হচ্ছে, একইসঙ্গে দুর্ঘটনাও ঘটছে সেটি হলো আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থার অভাব। কিছু স্টেশনে আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা থাকলেও অধিকাংশ স্টেশন এখনও সাধারণ পদ্ধতিতে ট্রেন চলে।  

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্র বলছে, যমুনায় বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। এজন্য ট্রেন চলাচলে মাত্র দুটি লাইন সচল রয়েছে। সেখানে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলিঙ্ক সিস্টেম (সিবিআইএস) নেই। জয়দেবপুরেও নতুন রেললাইন নির্মাণ চলছে, নেই সিবিআইএস। এতে করে ট্রেন বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকছে। আবার প্রকল্প চলমান থাকায় অনেক জায়গায় সিবিআইএস চালু করা যাচ্ছে না।  

এ সমস্যা কতদিনে সমাধান হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক বলেন, এক বছর লেগে যাবে। যতদিন (অটোমেটিক) সিগন্যাল ঠিক হবে না, ম্যানুয়ালি চলবে ততদিনে সমাধান হবে না।

ভোগান্তিতে যাত্রীরা

পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ টি ট্রেনই গত ৯ দিন ধরে সর্বনিম্ন আধা ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা দেরিতে চলায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা।

স্টেশনে সরেজমিনে দেখা যায়, যাত্রীরা দীর্ঘক্ষণ ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছেন। আবার দীর্ঘ অপেক্ষার পরে ট্রেন না পেয়ে যাত্রা বাদও দিয়ে দিচ্ছেন অনেকে।  এই ১৯ টি আন্তনগর হচ্ছে রংপুর এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, নীলসাগর এক্সপ্রেস, বুড়িমারী এক্সপ্রেস, একতা এক্সপ্রেস, রাজশাহী এক্সপ্রেস, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস, বনলতা এক্সপ্রেস, চিত্রা এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেস , সিল্কসিটি এক্সপ্রেস, ধূমকেতু এক্সপ্রেস, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, চিলাহাটি এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস। দেরিতে চলা তিন মেইল ও কমিউটার হচ্ছে রাজশাহী এক্সপ্রেস, ঢাকা কমিউটার ও টাঙ্গাইল কমিউটার।  

সূত্রমতে, পশ্চিমাঞ্চল রেলের রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর লাইনের প্রতিটি ট্রেন সর্বনিম্ন দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে চলাচল করছে। আবার রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী চারটি আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেন কয়েক ঘণ্টা দেরিতে চলাচল করছে।  

এদিকে যাত্রীরা বলছেন, যেসব ট্রেন বিলম্বে রয়েছে সেসব ট্রেন নিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। স্টেশনে থাকা বোর্ডে বিলম্ব লেখা ওঠে। কিন্তু ট্রেন কোথায় আছে বা কখন আসবে সেটা কেউ জানে না।

এ বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার শাহাদাত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ট্রেনগুলো স্টেশনে আসতেই দেরি হচ্ছে, এ অবস্থা ঠিক হতে কয়েকদিন সময় লেগে যাবে।  

ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, সাধারণত দুই ঘণ্টার বেশি হলেই যাত্রীরা টিকিত ফেরত দিতে চান। গত কয়েকদিন ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে এটি হচ্ছে।  

প্রসঙ্গত, গত ২ মে বগুড়ার সান্তাহার জংশন স্টেশনে যাত্রীদের সঙ্গে সংঘর্ষ, এর পরদিন ৩ মে জয়দেবপুরে মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। যেটা উদ্ধার করতে লেগে যায় ২৯ ঘণ্টা।  

এরপর ৯ মে রাত ৩টার দিকে ঈশ্বরদী-ঢাকা রেলপথের মুলাডুলি-চাটমোহর রেলস্টেশনের মধ্যে মুলাডুলি স্টেশন অতিক্রম করে আউটার সিগন্যালে দুর্ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৫ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২৪ 
এনবি/এসআইএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।