ঢাকা, রবিবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ জুন ২০২৪, ২২ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

রিমালে বাগেরহাটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, গাছচাপায় নারীর মৃত্যু

ডিস্ট্রিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৭ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০২৪
রিমালে বাগেরহাটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, গাছচাপায় নারীর মৃত্যু

বাগেরহাট: প্রবল ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা ও আম্পানের পর আরও একবার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব দেখল উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের মানুষ। প্রতিবার ঘূর্ণিঝড় এসে লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূলবাসীর ঘরবাড়ি, জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নেয় মাছের ঘের ও ফসলের ক্ষেত।

রক্ষা পায় না বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূল অতিক্রম করার পর যতই সময় গড়াচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে  ধ্বংসলীলার ক্ষত চিহ্ন।

জেলা প্রশাসন বলছে, বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের ধানসাগর গ্রামে ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন গাছ চাপায় ফজিলা বেগম নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লক্ষ মানুষ পানিবন্দি ছিল। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৪৫ হাজার ঘর-বাড়ি।  

শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: জাকির হোসেন খান মহিউদ্দিন জানান, সোমবার দুপুরের আগমুহূর্তে ওই নারী রান্না করছিলেন। তখন রান্না ঘরের উপর গাছ পড়লে ঘটনাস্থলেই ওই নারীর মৃত্যু হয়। ওনার স্বামীও বেশ অসুস্থ্য বিষয়টি এলাকাবাসী অনেক পড়ে জানতে পারে। রাতে স্থানীয় লোকজন নিয়ে গাছ সরিয়ে ওই নারীর মৃতদেহ বের করা হয়। আজ সকালে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রচন্ড বৃষ্টি, বাতাস, মোবাইলে চার্জ ও নেটওয়ার্ক না থাকায় বিষয়টি প্রশাসনকে জানাতে দেরি হয়েছে।

বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোঃ আল বিরুনী বলেন, বাগেরহাট সদর উপজেলার গোপালকাটি এবং শরণখোলা ও মোড়লগঞ্জের বেশ কিছু বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুর পর্যন্ত জেলার মোট ১.৪৮ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এখনো বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।

তিনি আরো বলেন, মোরেলগঞ্জের শ্রেণিকালী ও বাগেরহাট সদর উপজেলার গোপালকাটি এলাকায় বাধ মেরামতের কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ গুলো চিহ্নিত করে মেরামতের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাঃ খালিদ হোসেন বলেন, এই ঝড়ে ৫ লক্ষ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৪৫ হাজার ঘর বাড়ি। আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা দেওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে ৭৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১৯ লক্ষ টাকা ১১ হাজার কেজি চিরা, ৭শ কেজি গুড় ও ২০ হাজার প্যাকেট বিস্কুট দিয়েছি। সবকিছু মিলিয়ে সারাদিন বৃষ্টি না হওয়ায়, বাগেরহাটবাসী স্বাভাবিক হচ্ছেন।

এদিকে ঝড়ো বাতাসে বৈদ্যুতিক খুঁটি ও বিদ্যুৎ লাইনও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। জেলার ৫ লক্ষাধিক গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিলেন। বাগেরহাট শহরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হলেও এখনো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে বাগেরহাট উপকূলের ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ৪৫ হাজার গ্রাহক।  

বাগেরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহা ব্যবস্থাপক (জিএম) সুশান্ত রায় বলেন, ঝড়ে বিদ্যুতের ১১৪ টি পোল ভেঙে গেছে, হেলে পড়েছে ২১৭২ টি পোল, ১৫৪১ টি তার ছিঁড়ে গেছে, ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে ৩৭ টি, মিটার ভেঙেছে ৪৯৮ টি, ক্রস আর্ম ভেঙেছে ৭৩ টি, সার্ভিস ড্রপ তার ছিঁড়েছে ৪৬৭ টি, ইন্সুলেটর ভেঙেছে ৮৩ টি সকল লাইনম্যান, ঠিকাদারের লোকবল এবং স্থানীয় লেবার একযোগে লাইন পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। ঝড়ে লাইনে পতিত শত শত গাছ কেটে অপসারণ করার পাশাপাশি ছেড়া তার মেরামত করে বাগেরহাট সদর উপজেলার কিছু কিছু জায়গায় জোড়া দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখনো প্রায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

জলোচ্ছ্বসে বাগেরহাটে প্রায় ৩৫ হাজার মৎস্য ঘের ভেসে গেছে, চাষীদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭৩ কোটি টাকা।

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমলের প্রভাবে বাগেরহাটের ৩৫ হাজার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে চাষিদের প্রায় ৭০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া মাছের ঘেরের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি মিলে মোট ৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখনো বিভিন্ন স্থানে মাছের ঘেরগুলো পানিতে প্লাবিত রয়েছে যার ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। পুনরায় মাছ চাষের জন্য আমরা চাষিদের বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিচ্ছি।

ঝড়ে সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানিয়েছে বন বিভাগ। ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন সকাল থেকে বনের অভ্যন্তরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে কাজ শুরু করে বন কর্মীরা। একদিনে বনের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ৩৯ টি মৃত হরিণ, একটি বন্য শুকর এবং অর্ধশতাধিক আহত হরিণ উদ্ধার করেছে তারা। এছাড়া বন বিভাগের বিভিন্ন অফিস, নৌযান ও গাছগাছালির ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানিয়েছে সুন্দরবন বিভাগের খুলনার বনসংরক্ষক মিহির কুমার দো।  

তিনি বলেন, সুন্দরবনে এ পর্যন্ত ৩৯ টি হরিণ ও একটি বন্য শুকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আর ১৭টি হরিণ জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া বন বিভাগের টহল অফিসগুলোতে টিনের চালা, জানালা-দরজা, সোলার প্যানেল, ওয়ারলেস সিস্টেম ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। পূর্ব বন বিভাগের কটকা অভয়ারণ্যের অফিস ঘাটের জেটি ও পুকুর বঙ্গোপসাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দুবলা, কটকা, কচিখালি, বগিসহ বিভিন্ন বন অফিসসহ ২৫টি টহল ফাঁড়ির রান্নাঘরসহ অবকাঠামোর টিনের চালা উড়িয়ে নিয়ে গেছে। সুন্দরবনের ৮০টি মিঠাপানির উৎস পুকুরে ৮-১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বনকর্মীদের পাশাপাশি প্রাণীরাও সুপেয় পানির সংকটে পড়েছে।

এছাড়া জেলায় ১১ হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শংকর কুমার মজুমদার।

বাংলাদেশ সময়: ০১০০ ঘণ্টা,  ২৮ মে, ২০২৪
এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।