সাভার (ঢাকা): সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ৫ শয্যা বিশিষ্ট নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) চালু করতে ৫০ লাখ টাকা অনুদান দেন করোনা মহামারিতে প্রাণ হারানো মেধাবী শিক্ষার্থী সাবরিনা কামাল তন্বীর পরিবার।
সেই ৫০ লাখ টাকা অনুদান গ্রহণ করলেও হাসপাতালে চালু নেই কোনো আইসিইউ।
শনিবার (৮ জুন) সকাল ১০টার দিকে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ‘সাবরিনা কামাল তন্বী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র’ নামে একটি কক্ষ রয়েছে। কিন্তু শুধু নামেই, তাতে নেই কোনো কার্যক্রম, নেই কোনো যন্ত্রপাতি কিংবা যান্ত্রিক ভেন্টিলেটর। দুটি কার্ডিয়াক মনিটর দেখা গেলেও পুরো কক্ষটি কেমিক্যাল জারে পূর্ণ করে রাখা। কেন্দ্রটিতে ইন্ট্রাভেনাস লাইনের একটি ওয়েব, ফিডিং টিউবসহ নানা যন্ত্রপাতি থাকার কথা থাকলেও কিছুই নেই সেখানে। পড়ে আছে শুধু ৫টি শয্যা। সেগুলোতে নেই বিছানা-বালিশ।
প্রশ্ন উঠেছে - অনুদানের ৫০ লাখ টাকা গেল কোথায়?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘সাবরিনা কামাল তন্বী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র’ নামে আইসিইউসেবা প্রদান শর্তে ৫০ লাখ টাকা অনুদান দেয় সাবরিনার পরিবার। সেই অনুদান নিয়ে সব ধরনের প্রস্তুতিও সম্পন্ন করা হয়। ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর তৎকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ‘সাবরিনা কামাল তন্বী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র’ উদ্বোধনও করেন।
ওই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. নাজিম উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঢাকা-২০ আসনের এমপি বেনজির আহমেদ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের তৎকালীন নির্বাহী প্রধান ডা. মনজুর কাদির আহমেদ, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. মুহিব উল্লাহ খন্দকার উপস্থিত ছিলেন।
এত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে ফিতা কেটে আড়ম্বরে উদ্বোধন হলেও শেষ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি সাবরিনা কামাল তন্বী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রটি। হিসাব নেই অনুদানের ৫০ লাখ টাকারও।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সাবরিনার মা অধ্যাপক নাসরীন বেগম ‘এবি ব্যাংক’-এর একটি ২৫ লাখ টাকার চেক ও স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ড ব্যাংকের একটি ২৫ লাখ টাকার চেকসহ মোট দুই চেকে ৫০ লাখ টাকা প্রদান করেন। তৎকালীন সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান সমন্বয়ক ডা. মঞ্জুর কাদির ওই ৫০ লাখ টাকা উত্তোলন করে ‘সাবরিনা কামাল তন্বী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র’ স্থাপনে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পরে একই বছরের ২৯ অক্টোবর আইসিইউ কেন্দ্রটি উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেখানে একজন রোগীকেও চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। কারণ সেখানে নাম ছাড়া আইসিইউ কক্ষের কোনো সুবিধাই নেই।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ডা. মঞ্জুর কাদির যখন প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন তখন আইসিইউ -এর জন্য অনুদান প্রদান করা হয়। তিনি কী করেছেন তা উনি নিজেই জানেন। সাভার গণস্বাস্থ্যে কখনও কোনো আইসিইউ সুবিধা ছিল না, এখনও নেই।
তবে ‘সাবরিনা কামাল তন্বী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র’ নামের একটি কক্ষ রয়েছে বলে জানান তিনি।
অনুদানের টাকা আসলে কোথায় গেছে - তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের হিসাব শাখায় যোগাযোগ করে বাংলানিউজ।
ডা. মঞ্জুর কাদিরের রিসিভ করা এবি ব্যাংকের ২৫ লাখ ও স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ড ব্যাংকের ২৫ লাখ টাকার চেকের ফটোকপি ও চুক্তিনামা ছাড়া আর কিছুই দেখাতে পারেননি হিসাব শাখার কর্মকর্তারা।
খরচের কোনো ধরনের ক্যাশমেমো কিংবা খরচের কোনো হিসাব তাদের কাছে নেই বলে জানান হিসাব কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে সব দায়ভার ডা. মঞ্জুর কাদিরের বলে জানালেন সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের (মেডিকেল) প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবু তাহের।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ওই সময় ডা. মঞ্জুর কাদির প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন। এটার সব কিছু তিনিই করেছেন। তবে নিয়ম অনুযায়ী একটা হিসাব থাকার কথা থাকলেও তা আসলে নেই।
হিসাব না থাকলে টাকা তো খরচ করা হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তা অবশ্য ঠিক। এই টাকা আসলে তৎকালীন কর্মকর্তা ডা. মঞ্জুর কাদির কোথায় খরচ করেছেন সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন।
অভিযোগের বিষয়ে ডা. মঞ্জুর কাদির বাংলানিউজকে বলেন, আমি শুধু সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলাম। পরবর্তীতে কি হয়েছে, টাকা কি হলো সে বিষয়ে আমার জানা নেই। আমি জানি সম্পূর্ণ টাকা ডায়ালাইসিস সেন্টারে আইসিউ স্থাপনের জন্য অনুদান এসেছিল। সেখানে আইসিইউ স্থাপনও করা হয়েছিল। আমি ২০২৩ সালে কক্সবাজারে দায়িত্ব নিয়ে চলে এসেছি। পরে কি হয়েছে আমার জানা নেই।
তিনি আরও বলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে অভ্যন্তরীণ ঝামেলা চলছে। সে কারণে আমার দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, সাবরিনা কামাল তন্বীর মা ছিলেন ঢাকা কলেজের ইতিহাস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান। ২০১৯ সালে মে মাসে জার্মানিতে পিএইচডি করার সময় তার মেয়ে সাবরিনা কামাল তন্বী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। গরিব মানুষের চিকিৎসায় সহায়তা করলে তার মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে - এমনটা ভাবনা থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অধ্যাপক নাসরিন। তখন সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে আইসিইউ নেই বলে জানালে সেখানে আইসিইউ স্থাপনের জন্য ৫০ লাখ টাকা দেন তিনি।
সম্প্রতি অধ্যাপক নাসরিন বেগমের বক্তব্যের জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তার ব্যবহৃত ফোন নাম্বারটি দিতে অস্বীকৃতি জানায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৮ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০২৪
এসএএইচ