সিরাজগঞ্জ: রাতের সুনশান নীরবতায় সমস্ত জনপদ ঘুমিয়ে পড়লেও সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে জেগে থাকতে হয় সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নাইটগার্ড গোপাল চন্দ্র ভৌমিককে। হাতে লাঠি আর টর্চলাইট নিয়ে রাতভর পাহারা দিতে হয় গোটা অফিস ভবন।
রাতের ডিউটি শেষ হলেও সকাল পর্যন্ত তাকে অফিসেই থাকতে হয়। অফিস ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করার পর সকাল ৯টায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এলে ছুটি হয় গোপালের।
এভাবেই প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে পরদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত টানা ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করেন নাইটগার্ড গোপাল চন্দ্র। আর এ দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা ডিউটির মজুরি হিসেবে পান মাত্র ৬০ টাকা! ২০০৭ সাল থেকে এই মজুরি পাচ্ছেন গোপাল। এর আগে দেওয়া হতো প্রতিদিন ২০ টাকা।
জানা যায়, সলঙ্গা থানার বাসুদেবকোল গ্রামের হতদরিদ্র অজিত চন্দ্র ভৌমিকের একমাত্র ছেলে গোপাল চন্দ্র ভৌমিক (৪৫)। বাবা ছিলেন দিনমজুর। ২ শতাংশ জমির উপর ছোট্র একটি বাড়িতে অতিকষ্টে বসবাস করেন তারা। অসুস্থ বাবা-মা, স্ত্রী, দুই ছেলে ও স্বামী পরিত্যক্ত একমাত্র বোন নিয়ে ৭ জনের সংসার গোপালের।
১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নাইটগার্ড কাম ঝাড়ুদার হিসেবে দৈনিক মজুরিভিত্তিক অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় গোপালকে নিয়োগের আগে বলা হয়েছিল চার হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে। কিন্তু তখন তার দৈনিক মজুরি ধরা হয় ২০ টাকা। তারপরও তিনি চাকরিটাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল, একদিন এই চাকরি স্থায়ী হবে, সংসার চালানোর মতো ভালো বেতন দেওয়া হবে। কিন্তু এভাবে ২০ টাকা মজুরিতেই কেটে যায় দীর্ঘদিন। ৯ বছর পর ২০০৭ সালে তার দৈনিক মজুরি বাড়িয়ে করা হয় ৬০ টাকা।
গোপাল চন্দ্র ভৌমিক বলেন, জীবনের অর্ধেক সময় এই রেজিস্ট্রি অফিসেই কেটে গেল। চাকরিও স্থায়ী হলো না, বেতনও বাড়লো না। অভাবে অভাবেই কেটে গেল আমার জীবন। ২ শতক ছোট্ট বাড়ি ছাড়া কোনো সম্পদ নেই। ঘরে অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা-মা। ছোট ছোট দুটি ছেলেকে নিয়ে খুব কষ্টেই দিনাতিপাত করছি। বড় ছেলে গৌরব ৬ষ্ঠ শ্রেণি আর ছোট ছেলে নীরব তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ওদের পড়ার খরচ জোগাতেও পারি না। এর ওপর স্বামী পরিত্যক্তা বড় বোনকেও পালতে হয়।
তিনি বলেন, আমার স্ত্রী লক্ষ্মী রানী দর্জির কাজ করে ৬/৭ হাজার টাকা পান। আমি প্রতি মাসে অফিস থেকে মজুরি পাই ১৮শ টাকা। আর দিনে দুটি গরু পালন করি। সব মিলিয়ে মাসে ১০ হাজার টাকার মতো আয় হয়। এই দুর্মূল্যের বাজারে এই টাকা দিয়ে সংসার চালানো খুবই কষ্টকর। বাধ্য হয়ে ধার-দেনা করতে হয়।
এত কম বেতনে কেন চাকরি করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে গোপাল বলেন, আশা ছিল চাকরি স্থায়ী হবে, বেতন বাড়বে। সেই আশাতেই গত ২৬ বছর ধরে এখানে আছি। আমি শুধু একা নই, মফস্বলের সকল নাইটগার্ডই এই টাকা মজুরিতে ডিউটি করে যাচ্ছেন। কবে বেতন বাড়বে, কবে চাকরি স্থায়ী হবে এখনো জানি না।
সিরাজগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রার শরীফ তোরাফ হোসেন জানান, মাত্র ৬০ টাকা মজুরি দিয়ে এই সময়ে কারও সংসার চলতে পারে না। গোপাল চন্দ্র ভৌমিক ২৬ বছর ধরে চাকরি করছেন স্থায়ী হওয়ার আশায়। শুধু তিনি নয়, অনেক নাইটগার্ডই ভালো বেতন পাওয়ার আশায় চাকরি ধরে রেখেছেন। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা করছি খুব শিগগিরই মন্ত্রণালয় তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০২৪
এসএএইচ