ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

মাটির বিস্কুট ‘ছিকর’

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০২৪
মাটির বিস্কুট ‘ছিকর’

মৌলভীবাজার: শুনতে অবাক লাগলেও শিরোনামের বিষয়টি কিন্তু সত্যি। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন মাটি দিয়ে তৈরি বিস্কুট।

আর মানুষ এ মাটির বিস্কুট খায়। অর্থাৎ দেশের প্রত্যন্ত একটি অঞ্চলে মাটির বিস্কুট তৈরি ও বিপণন হয়।

তবে বলা বাহুল্য এক সময় এর বহুল ব্যবহার থাকলেও কালের বিবর্তনে আজ এসে ব্যাপক ধাক্কা খেয়েছে এ পণ্যটি। সন্তান সম্ভবা বা গর্ভবতী সনাতন নারীদের মুখে তুলে দেওয়া হতো এ ছিকর। কিন্তু গ্রামীণ নারীদের হাতের মমতায় তৈরি এ খাদ্যপণ্যটির মর্যাদা অনেকটাই ক্ষুণ্ন।

ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার নানা ঐতিহ্য-কৃষ্টি। ঠিক সেভাবে লোক সংস্কৃতির এ খাদ্যপণ্যটিও আজ বিলুপ্তির পথে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রয়োজনীয় চাহিদা ও বিপণন সংক্রান্ত সমস্যার কারণে কারিগররা আজ এটি তৈরি করতে আগের মতো আগ্রহ পাচ্ছেন না।

খাবারটির প্রসঙ্গে তনুশ্রী নামে এক নারী বলেন, আমাদের গ্রামে এক সময় দেখেছি গর্ভবতী নারীদের ছিকর খওয়ানো হতো। ওই পর্যায়ে নারীরা তখন আমাদের মতো অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার তো খেতে পারতেন না। প্রচণ্ড বমি বমি ভাব হতো। কিন্তু ওই খাবারটি খেলে এ বমি বমি ভাবটা হতো না। এখনের অবস্থা অবশ্য বলতে পারবো না- আমি প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে দেখেছিলাম।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের কিছু অধিবাসীরা ছিকর তৈরি করে থাকেন। তবে আগের মতো ব্যাপক নয়। এদের সংখ্যা কমে গেছে। কারণ একটাই ‘বাজার নেই আগের মতো’। আলোচনাকালে তাদের এ প্রতিধ্বনিত শব্দের ভেতর বহু কষ্ট গাঁথা রয়েছে।   

সম্প্রতি কুয়াশাময় এক সকালে কমলগঞ্জের জুগিবিল গ্রামে গিয়ে ছিকর কারিগরদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এ গ্রামটিতে শব্দকর সম্প্রদায় বসবাস করে। আগে থেকে আলাপচারিতা হয়ে থাকায় তারা অপেক্ষা করছিলেন বাংলানিউজের এ প্রতিবেদকের জন্য।

চোখে-মুখে তাদের চরম দরিদ্রতার ছাপ। তবু যেন একটা কিছুকে আঁকড়ে ধরে জেগে ওঠার তাগিদ।

এ গ্রামের রবীন্দ্র শব্দকর বাংলানিউজকে বলেন, আমরা মাটির বিস্কুট তৈরি করে থাকি। এগুলোকে আমরা ছিকর বলি। এটি নদী পাড়ের আটলা মাটি (এঁটেল মাটি) দিয়ে তৈরি করা হয়। আমাদের গ্রাম দেশে এগুলো গর্ভবর্তী নারীদের খাওয়ানোর প্রচলন রয়েছে। এগুলো খাওয়ার অর্থ হলো- নারীদের শরীরে কিছু পুষ্টি জোগায়। যারা জানে তারাই খায়। পরিমিতভাবে নারীরা খেয়ে থাকেন।  

বিস্কুটের মধ্যে ব্যবহৃত কয়েক প্রকারের মিশ্রণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিস্কুটে নদীর নিচের আটলা মাটি ছাড়াও বেলের পুটি, বন থেকে সংগ্রহ করা পূর্ণিমা লতার রস, আদার রস, গোলাপ জল, সাগু মিশিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে ৪ থেকে ৫টা উপকরণ এ মাটির বিস্কুটে মিশিয়ে দেওয়া হয়। তবে মাঝে মধ্যে গুড়ের লালিও মিশ্রণ করে থাকি। এগুলো মেশানোর ফলে খেতে খুব মজা লাগে এবং মাটির রং ফুটে। অর্জুনের রস নামে আরেকটি উপাদান যুক্ত করার বিষয়ে আমরা এক চিকিৎসকের পরামর্শ মতো পরীক্ষা করে দেখছি- এটি মিশ্রণ করা যাবে কি না।

ময়না রানী শব্দকর ও সঞ্চিতা রানী শব্দকর বলেন, নদী থেকে ১০ লিটারের বালতিতে ১ বালতি পরিমাণ মাটি আনার পর প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে মাড়া দিতে হয়। তারপর সেই মাটি মাড়া দেওয়ার পর একদিন রোদে শুকাতে হয়। তারপর ৪ থেকে ৫টি উপকরণ মিশ্রিয়ে চুলার ওপর প্রায় ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা শুকানোর প্রয়োজন পড়ে। মনে করেন ২০০ বিস্কুট ভালো করে বানাতে হলে ৩ দিন সময় লাগে। প্রতি পিস বিস্কুট পাইকারি আমরা ৩ টাকা করে বিক্রি করি।

এ বিস্কুট তৈরি করে তেমন লাভবান নই আমরা। তারপরও আমাদের এ ঐতিহ্যকে আমরা ধরে রেখেছি। তবে আগের মতো মাটি পাওয়া যায় না এখন। মাটির কারণে আমরা এখন অনেকটাই বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছি বলে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেন।  

উদাহরণ টেনে মাটির বিস্কুট তৈরির এ কারিগর বলেন, মনে করেন আপনার কিছু জমি রয়েছে। সেখানে এ বিস্কুট তৈরির জন্য আমরা ভালো মাটি পেয়েছি। যখনই দ্বিতীয়বার আনতে যাই তখনই আপনি আমাকে বাধা দিচ্ছেন। এভাবেই আমরা বঞ্চিত হই। যে জায়গা থেকে আমরা আগে মাটি আনতাম সেটা ছিল খুব ভালো মাটি। ময়দার মতো একদম। কিন্তু যখন তারা জেনে গেছে যে আমরা বিস্কুট তৈরি করি তখনই আমাদের আর সেই মাটি দেয় না। এটা আলিনগর চা বাগানের ফাঁড়ি বাগান সুনছড়া। বাগানের সাহেব এখন আর আমাদের মাটি দেয় না।

শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থী কাব্য বলেন, এ মাটির বিস্কুট আমাদের লোক সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্যবাহী খাদ্যপণ্য। আধুনিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপণনের জন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি শিল্প উদ্যোক্তা যদি এগিয়ে আসেন তাহলে এটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করতে পারে। সেই সঙ্গে নিশ্চিত হবে সংশ্লিষ্টদের আর্থিক স্বচ্ছতাটুকুও।

শব্দকর সম্প্রদায়ের তৈরি ছিকর নামে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী এ খাদ্যপণ্যটির বিলুপ্তি প্রসঙ্গে কমলগঞ্জ উপজেলার উপজেলা নির্বাহী (ইউএনও) কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের একটি বিস্কুটের কথা শুনেছি। তবে কেউ যোগাযোগ করেনি আমার সঙ্গে। শব্দকর সম্প্রদায়ের কারিগররা যদি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তবে আমি সাধ্যমতো তাদের সহযোগিতার চেষ্টা করবো।

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০২৪
বিবিবি/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।