মাদারীপুর: মাদারীপুর সদর উপজেলার খোঁয়াজপুরে আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে কুপিয়ে হত্যার নেপথ্যে রয়েছে ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা। একইসঙ্গে আওয়ামী শাসনামলে দিনের পর দিন অত্যাচার ও আধিপত্যজনিত তীব্র ক্ষোভও রয়েছে এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে।
জানা গেছে, গত বছর নিজের চাচা হোসেন সরদারকে হাতুড়িপেটা করে হাঁটু ভেঙে দেওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে খুন হয়েছেন সাইফুল সরদার (৩৫), তার ভাই আতাউর সরদার (৪০) ও চাচাত ভাই পলাশ সরদার (১৫)।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলার খোঁয়াজপুর ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন নিহত সাইফুল সরদার। সাংগঠনিক পদ পাওয়ার পর নিজ এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। নদী থেকে অবৈধভাবে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলনের ব্যবসায় থেকে শুরু করে বিচার-সালিশসহ একক আধিপত্য ছিল সাইফুলের। আধিপত্যের জের ধরে গত বছর নিজের চাচা হোসেন সরদারকে হাতুড়িপেটা করে পঙ্গু করে দেয় সাইফুল ও তার লোকজন। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর নিজ এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন সাইফুল। এরপর স্থানীয় হাটের ইজারাও নিয়ে নেন।
ফের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার জের এবং পুরানো প্রতিশোধ নিতেই প্রতিপক্ষের লোকজন শনিবার (৮ মার্চ) হামলা চালায় সাইফুল ও তার লোকজনের ওপর। এ সময় দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং সাইফুল ও তার ভাইসহ তিনজনের মৃত্যু হয়।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল সরদার দীর্ঘদিন ধরেই নিজ এলাকার কীর্তিনাশা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছিল। এলাকায় বালু ব্যবসায় একক আধিপত্য ছিল তার। গত বছর আরেক বালু ব্যবসায়ী হোসেন সরদারকে (৬০) প্রকাশ্যে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে দুই পা ভেঙে দেন সাইফুল সরদার। এলাকায় মাদকের সিন্ডিকেটও নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি হাটের ইজারাও নিয়েছিলেন সাইফুল।
এলাকায় হিটার সাইফুল হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। মাদারীপুর সদর থানায় এসব ঘটনায় ৭টি মামলা হয়েছিল সাইফুলের বিরুদ্ধে। এসব মামলা হলেও কিছুদিন জেল খেটে আবার শুরু করতেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এসব কারণে এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধও ছিল সাইফুলের ওপর।
দীর্ঘদিন এলাকায় কোণঠাসা হয়ে থাকা এবং হাঁটু ভেঙে দেওয়ার প্রতিশোধ নিতে হোসেন সরদার নতুন করে দ্বন্দ্বে জড়ান সাইফুলের সঙ্গে! শনিবার সংঘর্ষের এক পর্যায়ে সাইফুল, আতাউর ও পলাশকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় আ.লীগের দুটি বলয় ছিলে এখানে। এক পক্ষের নেতৃত্ব দিতেন সাবেক নৌ-পরিবহন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান এবং অপর পক্ষের নেতৃত্ব দিতেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাসিম। নিহত সাইফুল বাহাউদ্দীন নাসিম সমর্থিত খোয়াজপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। আর তার প্রতিপক্ষ অভিযুক্ত হোসেন সরদার (৬০) ছিলেন শাজাহান খান সমর্থিত আওয়ামী লীগ নেতা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থাকাকালীন নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সিন্ডিকেট ও খোয়াজপুর-টেকেরহাট বাজারের ইজারা দখল নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের জেরে ২০২৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে খোয়াজপুর বাজারের মধ্যে প্রকাশ্যে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হোসেন সরদারের দুই পা ভেঙে দেন সাইফুল সরদার ও তার লোকজন। তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাইফুল বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সখ্য বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এতে আরও ক্ষুব্ধ হয় স্থানীয়রা। পরে পা ভাঙার প্রতিশোধ ও পুরো সিন্ডিকেট দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে হোসেন সরদার। এ নিয়ে মাসখানেক আগে দুই গ্রুপের মধ্যে হামলা- ভাঙচুরেরও ঘটনা ঘটে। এই জেরেই শনিবার (৮ মার্চ) হামলা চালিয়ে সাইফুল ও তার ভাই আতাউরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে হোসেন সরদারের লোকজন। একই সঙ্গে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয় নিহত সাইফুলের আরেক ভাই অলিল সরদার ও চাচাতো ভাই পলাশসহ আরো ৮ জনকে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠালে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পলাশের মৃত্যু হয়।
নিহত সাইফুলের পরিবারের সদস্যরা জানান, ড্রেজার ব্যবসায় ছিল তাদের। সরকারের কাছ থেকে হাঁট ইজারা নিয়েছিলেন সাইফুল। হাট-ঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে নেওয়ার জন্যই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
নিহত সাইফুলের মা সুফিয়া বেগম বলেন,‘আমার ছেলেদের মেরে ফেলতেই শনিবার পরিকল্পিতভাবে ওরা হামলা করে। তিনদিক থেকে ঘেরাও করে। ওরা মানুষ ভাড়া করে অস্ত্র এনে আমার ছেলেরে মারে। বোমা মেরে আমার ছেলেকে ধাওয়া করে। প্রাণ বাঁচাতে মসজিদে আশ্রয় নেয়। সেখানে কুপিয়ে দুই ছেলেকে হত্যা করে। ’
এদিকে হোসেন সরদার ও তার ঘনিষ্ঠরা সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর থেকেই তারা গা-ঢাকা দিয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর সাহা বলেন, ‘বালু ব্যবসা ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এই মামলার ভিকটিম সাইফুল তার বংশীয় চাচা হোসেন সরদারকে পিটিয়ে পা ভেঙে দেন। সেই ঘটনায় মামলা হলে জেলা পুলিশ সাইফুলকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে বালু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় নিহত সাইফুলের মা সুফিয়া বেগম বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। আসামিদের গ্রেপ্তার করতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০২৫
এসএএইচ