মৌলভীবাজার: তীব্র খরায় পিছিয়ে যাচ্ছে চা-শিল্প। চৈত্র মাসের প্রখর রৌদ্রতাপ পুড়িয়ে দিচ্ছে বাগানের কোমলকচি চা পাতা।
সম্প্রতি চা বাগানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অনাবৃষ্টির ফলে চা-বাগানের সেকশনগুলোতে (চা বাগানের সুনির্দিষ্ট এলাকা) কিছু কিছু গাছ মরে শুকিয়ে যাচ্ছে। বালতি দিয়ে পানি চা গাছের গুঁড়িতে ঢেলেও চারা কোনো ক্রমেই বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
শীত মৌসুমে চা-বাগানগুলোতে পুরাতন চা-গাছ উপড়ে ফেলে সেখানে নতুন করে চারা-গাছ লাগানো হয়। বাগানের প্লান্টেশন এলাকার চা-গাছে প্রুনিং (আগাছা ছেঁটে দেওয়া) করার পরও কোনো কোনো চা গাছ মরে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে চাশিল্পেও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। চা-গাছ মরে যাওয়ার প্রধান কারণ প্রতিকূল আবহাওয়া। চা বাগানের চা-গাছের শেডট্রি বা ছায়াদানকারী গাছ উজাড় বন্ধ করা ও চা বাগানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী-নালা, ছড়া, খাল প্রভৃতি খনন করে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থাগ্রহণের নির্দেশনাও রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
চা সংসদের (বিটিএ) মালিকপক্ষের প্রতিনিধি এবং সিনিয়র টি-প্লান্টার ইবাদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, চা হলো বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ধরে চা গাছগুলো বেঁচে থাকতে সক্ষম। প্রায় পয়ত্রিশ বৎসর আগে যখন আমি টি ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখি তখন টি প্লান্টেশনের ইন্সট্রাকশন (চা আবাগের নির্দেশনা) ছিল যে, বাগানগুলোতে ৫০ ভাগ সীডলিংস চা (বীজ থেকে উৎপন্নকৃত চা) আর ৫০ ভাগ ক্লোন চা (বিশেষ চা গাছের টিস্যু থেকে উৎপন্নকৃত চা) লাগাতে হবে। সীডলিংসের একটা সুবিধা হলো এর প্রধান মূল খরার সময় পানি শোষণ করে বেঁচে থাকতে পারে। আর ক্লোনের মূলটা হয় গুচ্ছমূল। পানির লেয়ার (স্তর) ৩ ফুটের বেশি নিচে চলে গেলে আর মাটি থেকে পানি শোষণ করতে পারে না। যার ফলে এ চা গাছগুলো খুব সহজেই খরায় মরে যায়।
তিনি আরও বলেন, মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন সমতল বাগানগুলোতে আপনি দেখবেন ওই বাগানগুলোর বেশির ভাগ চারা ক্লোন হওয়ার ফলে খরা মৌসুমে টিকে থাকতে পারছে না। তীব্র খরায় চা গাছগুলোর মাথা শুকিয়ে মরে যাওয়ার উপক্রম হয়। এর অন্যতম কারণই হলো-ক্লোন চা গাছগুলোতে প্রধান মূল নেই। এগুলো যদি সীডলিংসের চা হতো তাহলে প্রতিটি চা গাছে প্রধান মূল থাকতো। আর এ প্রধানমূলগুলো মাটির একেবারে ৭-৮ ফুট নিচে চলে যায়। মাটির নিচ থেকে সহজে পানি শোষণ করতে পারে। আমাদের দেশের চা বাগান কর্তৃপক্ষ অধিক উৎপাদনের আশায় সমতলে ক্লোন চারা লাগিয়েছেন। কিন্তু দেশ যখন দীর্ঘমেয়াদী খরার কবলে পড়েছে তখন ওই চারাগুলো আর টিকে থাকতে পারছে না। পানির লেয়ার (স্তর) একেবারেই নিচে নেমে গেছে।
বাগানগুলো চা আবাদের নির্দেশনা না মানার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের অনেক চা বাগানেই কিন্তু এখনো ৮০- ৯০ বছরের চারা আছে। ওইগুলো কিন্তু সীডলিংস চারা। আমরা বিজ্ঞানভিত্তিক নির্দেশনা না মেনে চা বাগানে অতিরিক্ত ক্লোন চারা লাগিয়েছি। তখন আমাদের দীর্ঘমেয়াদী খরার কথা মনে ছিল না। ফলে বর্তমানে আমাদের মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে। ক্লোন চারাগুলোর মাথা সব জ্বলে গেছে। কিন্তু অপরদিকে সীডলিংস চারাগুলো বেঁচে আছে। চা বাগানের সব টিলায় ক্লোন চারা লাগানো যায় না। ক্লোন লাগানোর নিয়মনীতি না মানার ফলেই আজ চা বাগানের চারাগুলো খরায় মরে যাচ্ছে। যে বাগানগুলো ক্লোননির্ভর হয়ে গেছে সেগুলোর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ খরায়।
সমতল দুই রকম রয়েছে। উত্তরবঙ্গের সমতলের সঙ্গে আমাদের সিলেট-মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জের সমতল মেলালে হবে না। বৃহত্তর সিলেটের চা বাগানগুলো থেকে উত্তরবঙ্গের সমতলের হাইট (উচ্চতা) প্রায় ৪০-৫০ ফিট ওপরে। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলার চা বাগানগুলোর ছড়াগুলো পানিশূন্য। দীর্ঘদিন এসব ছড়া খনন না করার ফলে ভরাট হয়ে পানির জমাটবদ্ধতা বা গতিপ্রবাহ একেবারে হারিয়ে গেছে বলে জানান ইবাদুল।
হেক্টর প্রতি ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমতলের জন্য ক্লোন চা ভালো। কিন্তু যদি দীর্ঘমেয়াদী খরা থাকে তাহলে কিন্তু ক্লোন চা ক্ষতিকর। এর ফলেই চা গাছগুলোর মাথা মরে যায়। আমাদের এলপি (লাইট প্রুনিং, প্রুনিং মানে ছাটাই করা) করা চা গাছগুলোর মাথা যদি শুকিয়ে যদি ৪ ইঞ্চি নিচে নেমে যায় তাহলে খরার কারণে এর প্রভাব পড়বে আগামী তিন বছর। উৎপাদন একেবারে কমে যায়। একটা চা গাছের উচ্চতা সর্বোচ্চ ৩৬ ইঞ্চি হয়। যখন মাথা শুকিয়ে ৪ ইঞ্চি নিচে নেমে ৩২ ইঞ্চিতে পৌঁছে তাহলে প্রতি ইঞ্চিতে হেক্টর প্রতি (২.৪৭ একর) প্রায় ১০০ কেজি করে চা পাতা উৎপাদন কমে যায়। এ হলো অবস্থা!
এ জন্য টি এস্টেটে (চা উপত্যকা) অর্ধেক ক্লোন চারা অর্ধেক সীডলিংস চারা লাগানোর কথা বিশেষভাবে বলা আছে। তাহলে চা উৎপাদনের একটা ব্যালেন্স (ভারসাম্য) অটুট থাকে বলে জানান এ অভিজ্ঞ টি-প্লান্টার।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০২৫
বিবিবি/জেএইচ