ঢাকা: গানের মূর্ছনায় আলোয় আলোয় মুক্তির সন্ধানে রমনা বটমূলে চিরায়িত আয়োজনে বরণ করে নেওয়া হলো বাংলা নতুন বছরকে।
সোমবার (১৪ এপ্রিল) সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গানের মূর্ছনায় উৎসবমুখর আয়োজনে রমনা বটমূলে ১৪৩২ বরণ শুরু করে ছায়ানটের শিল্পীরা।
গান-কবিতা আর যন্ত্রের সুরে নতুন প্রভাতে নবজাগরণের আহ্বান শিল্পীদের। উৎসবপ্রিয় বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বরণ পেল ভিন্ন রং।
সোমবার সকাল সোয়া ৬টার দিকে আহির ভৈরব রাগে বাঁশির সুরে শুরু হয়েছে বর্ষবরণের এবারের আয়োজন। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মূল বার্তা ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। আলো, প্রকৃতি, মানুষ ও দেশপ্রেমের গান দিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের অনুষ্ঠান।
গান, বাজনা, আলাপে প্রত্যাশা করা হলো সুন্দর আগামীর। এর পরপরই পরিবেশন করা হয় সম্মিলিত কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত। বিগত বছরের অমঙ্গল দূর করে শুভ চিন্তার উদয় হোক এ প্রত্যাশা সবার।
আয়োজকরা জানান, সকাল সোয়া ৬টা থেকে শুরু হয় মূল পরিবেশনা। এতে অংশ নেয় নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রায় দেড়শ শিল্পী।
পরিবেশন করা হয় বৈশাখী গান ও কবিতা। মোট ২৪টি পরিবেশনার মধ্যে ৯টি সম্মিলিত গান, ১২টি একক গান ও কবিতা থাকবে তিনটি। এবারের নববর্ষের মূল কথন পাঠ করবেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী।
এবার বাংলা ১৪৩২ বরণ অনুষ্ঠান উদযাপনে মঞ্চের আকার অর্ধবৃত্তাকারে ৭২ ফুট লম্বা ও ৩০ ফুট প্রস্থ। গত তিন মাস ধরেই ধানমন্ডির ছায়ানট ভবনে মহড়া চলছিল। মূল পরিবেশনায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পুরুষরা পরেছেন মেরুন রঙের পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা। আর নারীরা পরেছেন মেরুন পাড়ের অফ হোয়াইট শাড়ি।
বিশ্বব্যাপী বস্তুর প্রতি মানুষের আকর্ষণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমেছে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। মানবতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সংকটে যেন মানুষ আশাহত না হয়, একে-অপরের পাশে থেকে, হাতে হাত রেখে চলার বার্তা ছড়িয়ে দিতেই আয়োজন করা হয়েছে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান।
বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পরিবেশনায় বড় শিল্পীদের পাশাপাশি অংশ নিচ্ছেন শতাধিক ক্ষুদেরাও। তারা দীর্ঘ আড়াই মাস অনুশীলন করেছেন। দুই ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করছে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।
এছাড়া ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজেও এটি সরাসরি দেখানো হচ্ছে।
বাঙালি জাতির শাশ্বত ঐতিহ্যের প্রধান অঙ্গ পহেলা বৈশাখ। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হলো নতুন বাংলা বর্ষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ। পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির জীবনে একটি পরম আনন্দের দিন। জীর্ণ পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক, ‘মুছে যাক গ্লানি’ এভাবে বিদায়ী সূর্যের কাছে এ আহ্বান জানায় বাঙালি।
পহেলা বৈশাখ আমাদের সব সঙ্কীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভেতরের সব ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যমে বাঁচার অনুপ্রেরণা যোগায়।
আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।
রাজধানীতে ১৯৬৭ সালে প্রথম রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের সূর্যোদয়ের সময় সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানট। সেই অনুষ্ঠানই মূলত নববর্ষ বরণের সাংস্কৃতিক উৎসবকে সারা দেশে বিস্তারিত হতে প্রেরণা সঞ্চার করেছে।
সেই থেকে (১৯৬৭) পহেলা বৈশাখ উদযাপনের একটা অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গও হয়ে উঠেছে ছায়ানটের বর্ষবরণের রেওয়াজ। এরপর কেবল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বৈরী পরিবেশের কারণে অনুষ্ঠান হয়নি। ২০০১ সালে এ গানের অনুষ্ঠানে জঙ্গিরা ভয়াবহ বোমা হামলা করে। এতেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি।
ছায়ানটের পাশাপাশি বর্ষবরণে থাকছে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রকমারি কারুপণ্যের সম্ভার নিয়ে বৈশাখীমেলা প্রভৃতি।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২৫
জিসিজি/আরএ