ঢাকা: বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী কারখানা, দোকান ও প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণে দেশের শ্রম আদালতে দায়ের করা ৬১ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি করতে পারেনি সরকার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) সময়ে শ্রম আদালতে মোট ১৪০৩টি মামলা রজু করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।
এদিকে সরকার আদালতের সংখ্যা বাড়িয়েও মামলার জট কমাতে পারছে না। বরং ওসব মামলার বিচারপ্রার্থীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে শ্রম আইনের জটিলতা, শ্রম আদালত ও শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের স্থান সংকটকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রম আদালতের মাধ্যমে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মামলা দায়ের করা হয়েছে মোট ১৪০৩টি এবং মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৫৫১টি। এর বিপরীতে জরিমানা আদায় হয়েছে ৩৬ রাখ ৮২ হাজার ৪০০ টাকা।
আরএমজি খাতে ১৪৩ মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৪টি, নন-আরএমজি খাতে ৪৭২টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ২২০টি, বিভিন্ন দোকানের ৪৬৮টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯৬টি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৮৪টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১১৮টি এবং শিশুশ্রমজনিত ৩৬টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩টি।
মাস হিসাবে ২০২৩ সালে জুলাই মাসে শ্রম আদালতে কারখানা, দোকান ও প্রতিষ্ঠান মিলে মামলা দায়ের করা হয়েছে ৮৫টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৫টি। আগস্টে মামলা হয়েছে ৫০টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ২৪টি। সেপ্টেম্বরে মামলা হয়েছে ১০৫টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৫৪টি। উক্ত অর্থ বছরের সবচেয়ে বেশি ৪৫৭টি মামলা হয়েছে অক্টোবর মাসে। নিষ্পত্তি হয়েছে ৮১টি। নভেম্বরে মামলা হয়েছে ১১৭টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ২৪টি। ডিসেম্বরে মামলা হয়েছে ৭৬টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৩টি।
এরপর ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে মামলা দায়ের করা হয়েছে ৮৬টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৪টি। ফেব্রুয়ারিতে হয়েছে ৭০টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৫০টি। মার্চ মাসে ১৩৪টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৩২টি। এপ্রিলে ৫৭টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৩১টি। মে মাসে ১২২টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ১০৩টি এবং জুনে মামলা দায়ের হয়েছে ৪৬টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৩০টি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ ও বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ অনুযায়ী কারখানা, দোকান ও প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণে কাজ করছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রথমে কারখানা বা প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শনপূর্বক শ্রম আইন ও বিধির লঙ্ঘনসমূহ চিহ্নিত করা হয় এবং তা প্রতিপালনের জন্য কারখানা ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বরাবর সময় উল্লেখপূর্বক নোটিশ প্রদান করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশোধন না করলে তাগিদপত্র প্রদান করা হয়। এছাড়া সময়ে সময়ে কারখানার মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে সচেতনতামূলক পরামর্শ প্রদান করা হয়। তারপরও নির্দেশনা পালন না করা হলে সংশ্লিষ্ট কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলা রুজু করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যার সঙ্গে মামলার জট বাড়ছে। মামলার জট কমাতে একটি আপিল ট্রাইব্যুনাল ও সাতটি শ্রম আদালতের সঙ্গে আরো ছয়টি শ্রম আদালত কাজ করছে। তারপরও কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না। বরং মামলা নিষ্পত্তিতে হয়রানি বেড়েছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও গাজীপুর ছাড়া অন্য জেলাগুলোতে শ্রম আদালত না থাকায় শ্রমিকদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এরপর মামলাজট ও কখনো বিচারক শূন্যতায় বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে।
আবার ঢাকার বাইরে শ্রম আদালতে কোনো শ্রমিক নিজের পক্ষে রায় পেলেও মালিকপক্ষের আপিলের কারণে সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে নতুন করে হয়রানিতে পড়তে হয়। কারণ ঢাকার বাইরে কোনো জেলায় আপিল ট্রাইব্যুনাল নেই। শ্রম আইনে ৬০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও একযুগ আগের মামলাও আদালতে বিচারাধীন।
এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, শ্রম আদালতের কার্যক্রম নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। সেখানে মামলাজটের পাশাপাশি শ্রমিকদের হয়রানির বিষয়টিও উঠে এসেছে। আমরা দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো। এ ক্ষেত্রে মামলাজটের কারণগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশেষ করে শ্রম আদালতে হাজার হাজার মামলা রয়েছে। এক গাজীপুরের কোর্টে আছে ৫ হাজার মামলা। একটা আদালত দিয়ে এত মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব নয়।
এদিকে শ্রম আদালতে মামলাজটের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, শ্রম আইনের জটিলতা, শ্রম আদালতের বিচারকদের বদলি, শ্রম আদালতের সদস্যদের উপস্থিতি, অধিক্ষেত্রজনিত জটিলতা, সহায়ক কর্মচারীদের অদক্ষতা, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অভাব এবং শ্রম আদালত ও শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের স্থান সংকট।
বাংলাদেশ সময়: ২৩৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০,২০২৫
জিসিজি