ঢাকা, শুক্রবার, ৭ ভাদ্র ১৪৩২, ২২ আগস্ট ২০২৫, ২৭ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

তৃতীয় পর্ব: আজিজ খান-ফারুক খান ভাইবেরাদারের অর্থ পাচার

ভাইবেরাদারের লুটতন্ত্র তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৫২, আগস্ট ২২, ২০২৫
ভাইবেরাদারের লুটতন্ত্র তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে সামিট গ্রুপ ছিল সরকারের ভিতর আরেক সরকার। অবাধ লুটপাটের জন্য তারা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেছে যথেচ্ছভাবে।

তারা যা চেয়েছে তা-ই হয়েছে। সামিটকে লুট করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। ট্যাক্স মওকুফ করা হয়েছে। সামিট গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের জন্য নিত্যনতুন ব্যবসা ফেঁদেছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাদের দেওয়া হয়েছে একের পর এক ব্যবসা। শুধু বিদ্যুৎ খাত নয়, তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও অবাধ লুটপাট করেছে সামিট গ্রুপ। সম্প্রতি এমনই একটি তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) দপ্তর থেকে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিটিআরসি থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল সামিট কমিউনিকেশনস কোনো ফি ছাড়াই তার শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সংস্থাটি। অভিযোগ উঠেছে, সামিট কমিউনিকেশনস নতুন শেয়ার ইস্যুর আড়ালে শেয়ার হস্তান্তর ও বিক্রি করছিল। সামিট কমিউনিকেশনস ২০০৯ সালে আত্মপ্রকাশের পর টেলিকম ও ইন্টারনেট সেক্টরের বৃহত্তম কোম্পানিতে পরিণত হয়। অথচ এর আগে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তাদের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। শুধু বাংলাদেশের টাকা লুট করে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়তেই এ খাতে নজর দেয় ভাইবেরাদার জুটি। প্রতিষ্ঠানটি গত বছরের মার্চের শেষের দিকে আবুধাবি ও মরিশাসভিত্তিক দুটি পৃথক কোম্পানির কাছে ১৭০ কোটি ৫ লাখ টাকা মূল্যের নতুন শেয়ার ইস্যুর জন্য বিটিআরসির অনুমোদন চায়। আবেদন অনুসারে প্রতিটি ১২ টাকা দরে মোট ১৪ দশমিক ২০ কোটি নতুন শেয়ার ইস্যু করা হবে। এর এক মাস পর এটির প্রাক-অনুমোদনের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পরের মাসেই সরকারি অনুমোদন আসে। এরপর চলতি বছরের ১২ জুন বিটিআরসি কোম্পানিটিকে কোনো চার্জ ছাড়াই শেয়ার ট্রান্সফারের অনুমতি দেয়। সরকারি অনুমোদনের জন্য পাঠানোর আগে বিটিআরসি আইন সংস্থার আইনি মতামত চেয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল-যেহেতু সামিট কেবল নতুন শেয়ার ইস্যু করছে, তাই মোট শেয়ার বিক্রির মূল্যের ওপর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ফি প্রদানের যে নিয়ম রয়েছে তা সামিট কমিউনিকেশনসের জন্য প্রযোজ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে সামিটও একই কথা উল্লেখ করে-‘এ ফি প্রযোজ্য নয়, কারণ কোম্পানিটি নতুন শেয়ার ইস্যু করে তার মূলধন বাড়াচ্ছে। ’ তবে বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বিটিআরসির আইনি ও লাইসেন্সিং বিভাগ শুরু থেকেই চার্জগুলো কোম্পানিটির ওপরই চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কারণ সামিট আসলে নতুন শেয়ার ইস্যু করার আড়ালে শেয়ার হস্তান্তর ও বিক্রি করছিল।

সামিট কমিউনিকেশনসের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ফরিদ খান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, তৎকালীন বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খানের ছোট ভাই। ফরিদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়েরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে সামিট বিশেষ সুবিধা পাচ্ছিল বলে ধারণা করা যায়। সামিট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে শেয়ার বিক্রির চুক্তিও বিটিআরসিকে জমা দেয়। সেখানে দেখা যায়-আবুধাবিভিত্তিক কোম্পানি গ্লোবাল এনার্জিকে সামিটের যে নতুন শেয়ার দেওয়ার চুক্তি হয়েছে, তার শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে একজন হলেন আদিবা আজিজ খান, যিনি ফরিদের বড় ভাই সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের মেয়ে। এ প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন শেয়ারের মধ্যে ১১৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ৯ দশমিক ৪৪ কোটি শেয়ার ইস্যু করা হয়েছিল। অন্যদিকে ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা মূল্যের আরও ৪ দশমিক ৪ কোটি শেয়ার মরিশাসভিত্তিক সেকোইয়া ইনফ্রা টেককে দেওয়া হয়েছিল।

গত বছর ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে বিটিআরসি আইন সংস্থাকে আবার চিঠি দেয় এবং বলে যে তাদের আইনি মতামত শুধু উপদেশমূলক এবং বাধ্যতামূলক নয়। এরপর গত বছরের ১৫ আগস্ট সামিট কমিউনিকেশনসকে তাদের শেয়ার হস্তান্তরের ফি না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন হয়েছে জানিয়ে চিঠি পাঠায় বিটিআরসি।

আইসিটিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফরিদ খান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে, আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়েরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় টেলিকম খাতে একক আধিপত্য বিস্তার করেন। প্রভাব খাটিয়ে ২০০৯ সালে আত্মপ্রকাশ করা সামিট কমিউনিকেশনস দেড় দশকে টেলিকম ও ইন্টারনেট খাতের বৃহত্তম কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। একচেটিয়াত্ব নিশ্চিত করতে টেলিকম খাতের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে তাদের। ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেছে সামিট গ্রুপ। মূলত অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমেই টেলিকম খাতে তাদের ব্যবসা শুরু হয়। আঞ্চলিক ফাইবার অপটিকস কেবলের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতকে যুক্ত করেছে সামিট কমিউনিকেশনস লিমিটেড। এ ছাড়া দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে যোগাযোগের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি), ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ, ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্ট্রিয়াল কেবলের (আইটিসি) লাইসেন্সও বাগিয়ে নিয়েছে সামিট। দেশের টেলিকম খাতের টাওয়ার শেয়ারিং ব্যবসায়ও নাম লিখিয়েছে সামিট টাওয়ার্স লিমিটেড। এ ছাড়া বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ক স্থাপনের কাজ করেছে সামিট টেকনোলজিস লিমিটেড। টেলিকম খাতে নানান সুবিধা নেওয়ার পর বাকি ছিল সাবমেরিন কেবল স্থাপনের কাজ। সেটিও গত বছর বাগিয়ে নিয়েছে সামিট। চাহিদার অতিরিক্ত পরিমাণ ব্যান্ডউইথের সরবরাহ থাকার পরও রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০২২ সালে সামিটসহ তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রথমবারের মতো বেসরকারি পর্যায়ে দেওয়া হয় সাবমেরিন কেবলের লাইসেন্স। এ ছাড়া দেশে ব্যান্ডউইথের সিংহভাগই আমদানি হচ্ছে সামিটের মাধ্যমে। কোম্পানিটির সাবসিডিয়ারি সামিট টাওয়ার্স লিমিটেডের মাধ্যমে দেশের টেলিকম খাতের টাওয়ার শেয়ারিং ব্যবসায়ও নাম লিখিয়েছে সামিট গ্রুপ। আবাসন খাতের ব্যবসার সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট রয়েছে সামিট গ্রুপ। ঢাকায় ৩২ লাখ বর্গফুট স্পেস নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গ্রুপটি। পাঁচ তারকা ও চার তারকা হোটেল নির্মাণের কাজও করেছে তারা। এ ছাড়া বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাই-টেক পার্ক স্থাপনের কাজ করেছে সামিট টেকনোপলিস লিমিটেড। সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড (এসএপিএল) বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় অব-ডক (অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল) ফ্যাসিলিটিগুলোর অন্যতম। তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি দেশের রপ্তানি পণ্যের কনটেইনারের ২০ এবং আমদানি পণ্যের কনটেইনারের ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ হ্যান্ডলিং করে। মুন্সীগঞ্জে এসএপিএলের গড়ে তোলা মুক্তারপুর টার্মিনাল দেশে বেসরকারি খাতের প্রথম অভ্যন্তরীণ নৌ টার্মিনাল ফ্যাসিলিটি। কোম্পানিটির একটি সাবসিডিয়ারি সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট ইস্ট গেটওয়ে (আই) প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে ভারতের কলকাতা বন্দরের জেটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু আজিজ খান এবং ফারুক খান নন, খান পরিবারের মোট ১১ সদস্য বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারে সম্পৃক্ত। সামিট গ্রুপের নামে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে তাঁরা যুক্ত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে এঁদের পাচারের অর্থ। গত ১৫ বছর এই খান পরিবারের যাঁরা অর্থ লুণ্ঠনে জড়িত তাঁদের মধ্যে আছেন মুহাম্মদ আজিজ খান, মুহাম্মদ ফয়সাল করিম খান, আঞ্জুমান আজিজ খান, আয়শা আজিজ খান, আদিবা আজিজ খান, আজিজা আজিজ খান, জাফর উদ্দিন খান, মুহাম্মদ লতিফ খান, মুহাম্মদ ফরিদ খান, সালমান খান ও মুহাম্মদ ফারুক খান। বাংলাদেশে এ পরিবার সম্মিলিতভাবে সবচেয়ে বেশি টাকা লুট করেছে।

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।