ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

নানা রোগে ৩ মাসে ৪৭ রোহিঙ্গার মৃত্যু

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৭
নানা রোগে ৩ মাসে ৪৭ রোহিঙ্গার মৃত্যু হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। ছবি: তুষার তুহিন

কক্সবাজার: মিয়ানমারের রাখাইন স্টেট থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বিশাল অংশ বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত ও ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে অনেকের শরীরেই রয়েছে একাধিক রোগের জীবাণু।

ডায়রিয়া, আমাশয়, পোলিও, পেপাটাইটিস এ ও ই, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, কলেরা, হাম, কালাজ্বর, গুটি বসন্ত, চর্মরোগ, বিলুপ্ত ডিপথেরিয়াসহ মারাত্মক সব পানিবাহিত ও ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গারা।

২৫ আগস্ট থেকে শুরু করে গত সাড়ে ৩ মাসে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৭ লক্ষ ৮০ হাজার ৩৪১ জনকে চিকিৎসা দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

এদের মধ্যে ডিপথেরিয়ায় ৬ ও এইডসে ২ জনসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ৪৭ জন রোহিঙ্গা মারা গেছে। ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কাটছে না কোনোমতেই।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) মো. শাহীন আবদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, রোহিঙ্গা গোষ্ঠীটি মিয়ানমারে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত ছিল। আমাদের দেশে আমরা বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে নানা ধরনের টিকা গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু তারা এদেশে আসার আগে কখনো কোন ধরনের টিকা গ্রহণ করেনি। এজন্য রোহিঙ্গারা নানা ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত। পাশাপাশি তাদের মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ।

তিনি আরো বলেন, গত সাড়ে তিন মাস ধরে সদর হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ রোহিঙ্গা রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।  

আরএমও আরো বলেন, একটি রোগাক্রান্ত বিশাল জনগোষ্ঠী যখন কোন এলাকায় প্রবেশ করবে তখন সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের উপরও তার প্রভাব পড়ে। তাই স্বাভাবিকভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে কক্সবাজারের বাসিন্দারা।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, জাতিসংঘ ও আরআরআরসি হিসেব মতে, গত সাড়ে ৩ মাসে কক্সবাজারে প্রবেশ করেছে ৬ লক্ষ ৪৬ হাজার ৭৮১ জন রোহিঙ্গা। তবে এই হিসেব করা হয়েছে স্থানীয়দের থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে।

তিনি আরো বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগসহ রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করা দেশি বিদেশি এনজিও’র কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, আগত রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ নানা রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশী।

কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম বাংলানিউজকে  বলেন, ২৫ আগস্টের পর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ৭ লক্ষ ৮০ হাজার ৩৪১ জন রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা দিয়েছে। এদের মধ্যে ডায়রিয়া রোগী ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ৫১৯ জন, সর্দি, জ্বর, কাশি ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ২ লক্ষ ৪ হাজার ৮৪০ জন, হামের রোগী ৬৮ জন, জন্ডিসে আক্রান্ত ১ হাজার ৩৬৫ জন, চর্মরোগী ৬৫ হাজার ২৩১ জন, অপুষ্টির শিকার ২০ হাজার ৯৩৬ জন, মানসিক সমস্যায় ভুগছে ৩ হাজার ২৪২ জন, টিবি’তে আক্রান্ত ৭৪ জন। এছাড়া অন্যান্য নানা রোগে আক্রান্ত ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৫৭৭ জন রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

তাছাড়া ১০৭ জন এইডস রোগী এবং ১১০ জন ডিপথেরিয়া আক্রান্তকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। একই সময়ে ৩ হাজার নারী এদেশে এসে সন্তান প্রসব করেছে। এছাড়া এই মুহুর্তে গর্ভবতী নারী রয়েছে আরো ২২ হাজার।   নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থা নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ৪৭ জন রোহিঙ্গা মারা গেছে।

সিভিল সার্জন আরো বলেন, একজন রোহিঙ্গার শরীরে একাধিক রোগ রয়েছে। এমন রোগীও আমরা পেয়েছি যিনি একদিকে সর্দি, জ্বরে আক্রান্ত, অন্যদিকে সারা শরীরে চর্মরোগ রয়েছে। এছাড়া পাশাপাশি সেই রোগী অপুষ্টিরও শিকার ছিল।

সরেজমিনে গতকাল কুতুপালং, বালুখালি, মধুরছড়া, গুলশান পাহাড়, আমতলী ও জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে দেখা যায়, মেডিকেল ক্যাম্পগুলোর সামনে লম্বা ভিড়। চিকিৎসকরা আগতদের অধিকাংশ চর্মরোগ, ডায়রিয়া, আমাশয় ও সর্দি জ্বরে আক্রান্ত। আগতদের বেশীরভাগ, শিশু, নারী ও বৃদ্ধ।

ওই সময় আমতলী রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা নিতে আসা রোহিঙ্গা নারী সুফিয়া বাংলানিউজকে বলেন, মিয়ানমারের থাকা অবস্থা থেকেই তার মাঝে মাঝে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসত। আবার ঘাম দিয়ে ছেড়ে যেতো। তার হাঁটুতে, বাহুতে ব্যথা করে। এজন্যই মেডিকেল ক্যাম্পে এসেছেন। এখানে আসার পর তার রক্ত পরীক্ষা করা হয়। পরে তার শরীরের ম্যালেরিয়া ধরা পড়ে। এখন তিনি এসেছেন ম্যালেরিয়ার ওষুধ নিতে।

এ বিষয়ে রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল টিমের এক স্বেচ্ছাসেবী বলেন, রোহিঙ্গারা অসচেতন। তাদেরকে সচেতন করতে গত তিন মাস আমরা এখানে কাজ করছি। যাদের সাথে আমরা এ পর্যন্ত কাজ করেছি তাদের শতকরা ৫ ভাগকে সচেতন করতে পেরেছি।

উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, কলেরা, টাইফয়েড়, ডিপথেরিয়া, পোলিও ও হামের মত ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত রোহিঙ্গারা। এদের সেবা দিতে উখিয়ায় ৪৮ টি ও টেকনাফে ১২টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
 
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম বাংলানিউজকে বলেন, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৩ লক্ষ ৯১ হাজার ৩৯৭ জনকে কলেরার টিকা, ১ লক্ষ ২৭ হাজার জনকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল, ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৭৫০ জনকে রুবেলার টিকা ও ৬৯ হাজার ৫৩৯ জন রোহিঙ্গাকে পোলিওর টিকা খাওয়ানো হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, শনিবার থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডিপথেরিয়ার প্রতিষেধক টিকা দেওয়া হচ্ছে। আমরা ৫ লক্ষ রোহিঙ্গাকে এই টিকা প্রদান করব।

এছাড়া রোহিঙ্গাদের চিকিৎসায়, ১০০ জন এমবিবিএস, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ইন্টার্ন চিকিৎসক, মেডিকেল স্টুডেন্টসহ ২ হাজার জনবল কাজ করছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৭
টিটি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।