ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

এই শহর সবার জন্য নয়!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৮
এই শহর সবার জন্য নয়! রাস্তায় হুইলচেয়ার নিয়ে চলার সুযোগ নেই বলে আক্ষেপ ঝরে টুকু মিয়ার কণ্ঠে। ছবি: মাজেদুল হক

ঢাকা: মাত্র তিন বছর বয়সে পোলিওতে পঙ্গু হয়ে পড়েন টুকু মিয়া। গরিব ঘরে অন্য কেউ যে বসে খাওয়াবে, সেই দায়ও নেই কারো। নিজের প্রয়োজনেই খোঁড়া পা নিয়ে বের হতে হয়েছে। কিন্তু খুলনা থেকে ঢাকায় এসে টুকু মিয়ার প্রতিদিনের জীবন যেন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়লো!

বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) দুপুরে টুকু মিয়ার সঙ্গে দেখা হয় গুলশানে। এই শহরে একসঙ্গে এতো উন্নয়ন কাজ গত প্রায় ৪৭ বছরে দেখা যায়নি।

শহরের ফুটপাতগুলো সব ভেঙে নতুন করে ঠিক করা হচ্ছে। তবে এই কাজ যেন অনন্তকালের। গত দুই মাস ধরেই দেখা যায় গুলশান, বনানী, মিরপুর, ফার্মগেট আর ধানমন্ডির ফুটপাতগুলোতে সংস্কারের কাজ চলছে। এই পথগুলো টুকু মিয়ার মতো প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়। যেখানে হুইলচেয়ার নিয়ে চলা যায়।

টুকু মিয়া বাংলানিউজকে বলছিলেন, ‘শুধু এই পথগুলো নয়, রমনা বা বাংলামোটরের অনেক ফুটপাতগুলো এমনভাবে আটকে রাখা হয়েছে যেন, মোটসাইকেল ফুটপাতে উঠতে না পারে। কিন্তু তাতে কেবল মোটরসাইকেল নয়, আমাদের মতো হুইলচেয়ারে চলা ব্যক্তিরাও চলতে পারেন না। ’

৬১ বছর বয়সী টুকু মিয়া বলেন, ‘একসময় কাঠের স্ট্রেচার ব্যবহার করে চলাফেরা করতাম। বিভিন্ন স্থানে ফুটপাতে হকারি করতাম। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন আর পারি না। গত তিন বছর ধরে হুইলচেয়ার ব্যবহার করি। এখন যাতায়াত আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। এই দেশে বাসে, ট্রেনে, সিএনজিতে কোথাও ওঠা যায় না। রিকশা সব রাস্তায় চলেও না। ’

তবে অনেক রিকশাওয়ালা টুকুদের মতো প্রতিবন্ধীদের তার বাহনে ওঠান এবং নিজেরাও হুইলচেয়ার ওঠাতে সাহায্য করেন বলে জানান তিনি।

টুকু মিয়া বলেন, ‘যদি ফুটপাতগুলো ভাল হতো, তবে সবখানে গাড়ি ছাড়াও অনেকটুকু চলা যেতো। এখন গাড়ির পথ দিয়ে তো আর হুইলচেয়ার চালানো যায় না। আবার শহরের ফুটপাতগুলো এমনভাবেই উঁচু করা, যেন মোটরসাইকেল না উঠতে পারে। মোটরসাইকেল ঠেকাতে গিয়ে আমাদের মতো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কথা একবারও ভাবা হয়নি। ’রাজীব আহমেদরা চলতে পারেন না ফুটপাত দিয়েও।  ছবি: মাজেদুল হকটুকুর কথায় আক্ষেপ ঝরে, এই শহরের কোনো বাসে, ট্রেনে বা অন্য কোন যানবাহনে হুইলচেয়ার ওঠানোর ব্যবস্থা নেই। এখানকার বাসগুলো বাস স্টপেজে থামে না। ফুটপাতগুলোও বাসের দরজার মাপে করা হয়নি, এখানে সড়কে কোথাও এমন ব্যবস্থা রাখা হয়নি, যে অংশ দিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পার হতে পারবেন।

৮ বছর বয়স হতেই চোখে দেখতে পান না রাজীব আহমেদ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ দেশের বাসগুলোতে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত নয়টি আসন রাখা হয়েছে। কিন্তু সেখানে কি নারী ছাড়া আর কাউকে বসতে দেওয়া হয়? আমাদের বাসে উঠতে দেওয়া হয় না। আরেকজনের সাহায্য ছাড়া কোনো বাসে ওঠা যায় না। সেখানে উঠলেও কেউ বলে না, বাসটি কোথায় এসেছে বা কতোদূর আছে। ’

তিনি বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে শহরের ফুটপাতগুলোর এমন অবস্থা যে এখন চলাচলই বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ আমাদের একটি মাপ আছে চলার। প্রতিদিনকার চলার পথের একটি ধারণা থাকে। কিন্তু এই শহরের পথের কোন ধারণা করা কঠিন। ’

এখানে সাদা ছড়ি কাজ করে না। ফুটপাতগুলোর উচ্চতা একস্থানে এক রকম। আবার বেশিরভাগ ফুটপাতেই হকার বসা। যেগুলোতে হকার নেই, সেখানে হয়তো ম্যানহোলের ঢাকনা ওল্টানো বা খাদ হয়ে আছে অথবা পাশের কোনো ভবন বা সড়কের নির্মাণ কাজের ইট-সুড়কি রাখা।

এই প্রসঙ্গটি টেনে রাজীব বলেন, ‘প্রতিনিয়ত আমাদের মতো অন্ধ ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনার শিকার হন। এখানে কোথাও সড়ক পার হওয়ার ব্যবস্থা নেই। এমন কোনো সিগন্যাল নেই বা সিস্টেম দেওয়া নেই, যেখান থেকে আমরা পথ চলার নির্দেশনা পাবো। ’

দেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির মতো সমান অধিকার ভোগ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই সংবিধান প্রদত্ত অধিকারের দিকে কর্তৃপক্ষের কোনো খেয়াল নেই বলে আক্ষেপ আর অভিমান ঝরে টুকু মিয়া ও রাজীব আহমেদদের কণ্ঠে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৮
এমএন/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।