ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আইসিইউর দরজার দিকেই নজর তাদের!

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯
আইসিইউর দরজার দিকেই নজর তাদের!

ঢাকা: ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-আইসিইউতে সাধারণত যে ধরনের রোগীরা থাকেন তাদের সবাই অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকেন। সবাই যে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকেন তা কিন্তু নয়। কিন্তু রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউ’র দরজা খুললেই যেন মৃত্যুর আতঙ্ক। এই বুঝি কারও মৃত্যুর খবর এলো! ভেতরে লাইফ সাপোর্টে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন আগুনে দগ্ধ রোগীরা। আর বাইরে অপেক্ষা করছেন স্বজনেরা। তাদের নজর আইসিইউর দরজার দিকেই।

শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউর সামনে এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে।

কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের।

এদের মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটনাস্থলেই হয়েছে। আহতদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন আরও ১০ জন।

বুধবার রাত ১২টা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর ৪টার মধ্যে চিকিৎসাধীন ৮ জনের মৃত্যু হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে দেড়টার মধ্যে মারা যান আরও ৪ জন। অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ১০ জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন।

আইসিইউতে নিয়ম অনুযায়ী বাইরের কেউ প্রবেশ করতে পারে না। আগুনে দগ্ধ রোগীদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম আরও কঠোর। ভেতর থেকে কেউ বের হলেই আঁতকে উঠছেন চিকৎসাধীন রোগীদের স্বজনেরা। আবার মাঝে মাঝে রোগীদের দূর থেকে দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তখন রোগীর নাম ধরে ডাক শুনলেই স্বজনরা দৌড়ে এগিয়ে আসেন ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে। এসেই জিজ্ঞাসা, ডাক্তার কী খবর?

আইসিইউর সামনে মেঝেতে বসে আহাজারি করছিলেন অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৯৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়া সোহানের (১৯) মা। কিছুক্ষণ আহাজারি করছেন, কাঁদছেন, আবার মাঝেমধ্যে দোয়াও করতে দেখা যায় দুই হাত তুলে। পাশে আছে সোহানের ভাই, চেষ্টা করছেন সান্তনা দেওয়ার।

আইসিইউর দরজার সামনে অপেক্ষা করছিলেন শতভাগ পুড়ে যাওয়া রোগী আব্দুর রাজ্জাকের শ্যালক ওয়াহিদ। আইসিইউর দরজা খুললেই তাকিয়ে থাকেন সেদিকে। তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। তার পাশেই অপেক্ষা করছেন তার ছোট বোন। সেও দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর রাজ্জাকের স্ত্রী গুলশানার অবস্থা আরও নাজুক। সঙ্গে রাজ্জাক-গুলশানা দম্পতির একমাত্র সন্তান টুম্পা আক্তার (১৫)।

ওয়াহিদ বাংলানিউজকে বলেন, যেকোনো সময় মৃত্যুর খবর আসতে পারে। ডাক্তার বলেছে শতভাগ পোড়া রোগী নাকি বাঁচে না। আমরা চিন্তায় আছি টুম্পার ভবিষ্যত নিয়ে। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, আমরা মৃত্যুর খবরের অপেক্ষা করছি। আইসিইউর গেট খুললেই আতঙ্ক কাজ করছে। গতকাল একবার খবর পেলাম দুলাভাই মারা গেছেন। আমাদেরকে ২০ হাজার টাকা অনুদানও দেওয়া হয়েছে। আপা (গুলশানা) দেখতে গিয়ে দেখেন তার হাতে কাটা দাগ। পরে দেখা যায় দুলাভাই বেঁচে আছেন। মারা গেছেন ওমর ফারুক নামের আরেকজন। এদের কারোরই মুখ দেখে চেনার উপায় নেই। পুড়ে গেছে।

...

ওয়াহিদ আরও বলেন, দুলাভাইয়ের কানের একাংশ পুড়ে দলা হয়ে গালের সঙ্গে লেগে ছিল। এখানে অক্সিজেন মাস্ক পরানোর সময় তা খুলে পড়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় বাঁচার আশা করা আসলেই বৃথা।

একই কথা জানিয়ে সামন্ত লাল সেন জানান, প্রত্যেকেই লাইফ সাপোর্টে আছে। সবার ইনহ্যালেশন বার্ন এবং বার্নের পরিমাণ এমন যে আমার এই ৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় এত ভয়াবহ বার্ন আমি কখনো দেখিনি। যেমন গতকালকে এখানে একজন রোগী মারা গেছে যাকে তার স্ত্রী চিনতে পারেনি। মুখমন্ডল এমনভাবে বিকৃত হয়েছিল। পরে তার হাতের কাটা দেখে তাকে শনাক্ত করতে পেরেছে। বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে এমন আগুনে পোড়া রোগীও রয়েছে যাদের মুখ চেনা যাচ্ছে না। শ্বাসনালী খুব খারাপভাবে পুড়ে গেছে এবং যে ১০ জন রোগী এখনও রয়েছে তাদের সবার শরীরের ৬০ থেকে ৮০ ভাগ পোড়া এবং আব্দুর রাজ্জাক নামের একজনের শতভাগ পোড়া।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। অধিকাংশ মরদেহই ১০০ ভাগ পোড়া।

ঢাকার কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় অবস্থিত ‘প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’র প্লাস্টিকসামগ্রী তৈরি কারখানায় বুধবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাস্থলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে একজনের মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশ সময়: ২১২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯
এমএএম/এইচএডি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।