ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

আরো দখলের পাঁয়তারা

‘বনভূমি খেকোর’ দখলে রাঙ্গুনিয়ার ৫০ একর পাহাড়ি জমি

বাংলানিউজ টিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০২০
‘বনভূমি খেকোর’ দখলে রাঙ্গুনিয়ার ৫০ একর পাহাড়ি জমি নিষিদ্ধ থাকলেও পাহাড়ের গাছ কেটেছেন বৌদ্ধ ভিক্ষু শরনংকর থের। ছবি: বাংলানিউজ

রাঙ্গুনিয়া থেকে ফিরে: বৌদ্ধ ভিক্ষু শরণংকর থের। রাঙ্গুনিয়ার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় তার বসবাস।

ধর্মীয় লেবাসে তিনি গিলে খাচ্ছেন পাহাড়ের একরের পর একর জমি। কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছেন কিছুদূর পরপর একটি ধর্মীয় স্থাপনা কিংবা বৌদ্ধমূর্তি নির্মাণ। বন বিভাগের নিষেধাজ্ঞা কিংবা মামলা- কোনো কিছুতেই থামছেন না তিনি। এরইমধ্যে তিনি দখলে নিয়েছেন পাহাড়ের ৫০ একর জমি। দখলের পাঁয়তারা করছেন আরো ১০০ একরের মতো।

ঘটনা চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের ফলাহারিয়ার দুর্গম পাহাড়ি এলাকার। শরণংকর থের সেখানে প্রায় ৫০ একর পাহাড়ি জমি দখল করে গড়ে তুলছেন একের পর এক ধর্মীয় স্থাপনা। তবে আসল উদ্দেশ্য জমি দখল। বনবিভাগের জমি এবং সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণ দণ্ডণীয় অপরাধ- এমন সাইনবোর্ড বসানো থাকলেও সেসব থোড়াই কেয়ার করে ঠিক এর গা ঘেঁষেই তিনি গড়ে তুলছেন স্থাপনাগুলো। এমনকি সরকারি জায়গায় বনায়নও করতে পারছে না বন বিভাগ। বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় তিনি এসব করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, শরণংকর থেরের দখল করা বনবিভাগের পাহাড়ি জায়গায় এলাকাবাসীর গরু-ছাগল প্রবেশ করলেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একটি গরু হত্যার অভিযোগে ৫৮ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণও দিয়েছেন একবার। সাধারণ মানুষ বন থেকে কাঠ-লাকড়ি সংগ্রহ করতে গেলে তাদেরও মারধর করেন তিনি। তার এই দখলের পরিসর দিন দিন বাড়ছে। আরো একশ একর বনভূমি দখলের চেষ্টা করছেন শরণংকর থের। এরই অংশ হিসেবে তার নিজস্ব লোকজন দিয়ে প্রতিনিয়ত বনভূমির গাছ কাটছেন। দীর্ঘদিন ভয়ে বনবিভাগ কিছু বলার সাহস না পেলেও সম্প্রতি দখল করা বনভূমি উদ্ধারের চেষ্টা করছে।

শুধু যে বনভূমি দখল করছেন তাই নয়, পাহাড় ও গাছ কেটে পরিবেশের ক্ষতি করে তৈরি করছেন স্থাপনা। পরিবেশ অধিদফতর পরিদর্শন করে এর সত্যতা পাওয়ায় মামলাও দায়ের করা হয়েছে। অধিদফতরের চট্টগ্রাম জেলার পরিদর্শক হারুন-অর-রশিদ পাঠান বাদি হয়ে রাঙ্গুনিয়া থানায় এ মামলা দায়ের করেন।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের খুরুশিয়া রেঞ্জের সুখবিলাস বিট অফিস সূত্রে জানা যায়, বনবিভাগের জায়গা অবৈধভাবে দখল ও সেখানে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগে শরণংকর থেরের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলাও করেছে বনবিভাগ।

মামলাগুলোর মধ্যে তিনটি বন আদালতে ও তিনটি থানায় দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় সরাসরি অভিযুক্ত শরণংকর থের। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠির মাধ্যমেও জানায় বনবিভাগ। এছাড়া অবৈধ স্থাপনায় নেওয়া বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতেও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, রাঙ্গুনিয়াকে চিঠি দেয় বনবিভাগ। তবুও সেখানে রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। সরজমিনে রোববার (১১ অক্টোবর) দুপুরে পদুয়া ইউনিয়নের ফলাহরিয়ার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবৈধভাবে শরণংকর থেরের গড়ে তোলা ‘জ্ঞানশরণ মহাঅরণ্য বৌদ্ধ বিহারে’ গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি পাহাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি করে ধর্মীয় স্থাপনা। আর এসব স্থাপনা তৈরির অজুহাতে কাটা হয়েছে অসংখ্য গাছ।

বনবিভাগের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, রাতের আঁধারে নিজস্ব লোকজন দিয়ে বনের গাছ কেটে ফেলেছেন শরণংকর থের। গাছ কাটায় বাধা দেওয়ায় মারধরের শিকারও হয়েছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের খুরুশিয়া রেঞ্জের সুখবিলাস বিট কর্মকর্তা মো. আশরাফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বনবিভাগের ৫০ একর জায়গা ইতোমধ্যে দখল করে রেখেছেন শরণংকর থের। বনবিভাগের জায়গায় অবৈধভাবে স্থাপনা তৈরি করেছেন তিনি। তার অবৈধ কাজে বাধা দিলে আমার ওপর হামলা করে তার বাহিনী। আমরা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি।

‘সরকার ঘোষিত বনায়নের অংশ হিসেবে আমরা ৯০ হাজার গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নেই। এর আগের দিন রাতে প্রায় ৭০ হাজার চারা কেটে ফেলেন শরণংকর থের ও তার বাহিনী। কাউকে তোয়াক্কা করেন না তিনি। তার অবৈধ কাজে বাধা দেওয়ায় আমার চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকিও দিয়েছেন। এসব বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ’রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান-১ মো. শাহজাহান বাংলানিউজকে বলেন, শরণংকর থের প্রায় ২০০ একর বনভূমি দখলের পাঁয়তারা করছেন। তার বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দারা আমাদের কাছে নানান অভিযোগ করেছেন। তিনি ইউনিয়ন পরিষদকেও তোয়াক্কা করেন না।

প্যানেল চেয়ারম্যান-২ মো. বদিউজ্জামান বদি বাংলানিউজকে বলেন, শরণংকর থের বনভূমি দখল করে একটি ‘মিনি ক্যাম্প’ তৈরি করে ফেলেছেন। আশপাশের মানুষ তার কাছে একপ্রকার জিম্মি। মিয়ানমারসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে তার ‘মিনি ক্যাম্পে’ লোকজন আসে। কিন্তু ভেতরে কী হচ্ছে তা কেউ জানে না। পুলিশ প্রশাসনও কিছু জানে না। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। আমরা তাকে গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে শরণংকর থের’র ‘জ্ঞানশরণ মহাঅরণ্য বৌদ্ধ বিহারে’ গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। জানা যায়, বেশকিছু দিন ধরে তিনি সেখানে অবস্থান করছেন না।

দখলের শুরু যেভাবে

২০১২ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার পদুয়ার ফলাহারিয়ার পাহাড়ে ছনের ছাউনি দিয়ে ছোট্ট একটি ঘর বানিয়ে থাকা শুরু করেন শরণংকর থের। তখন তিনি স্থানীয়দের জানিয়েছিলেন কিছুদিন ধ্যান করে চলে যাবেন। কিন্তু তিনি আর যাননি।

কিছুদিন পর সেখানে টিনের ছাউনি দিয়ে ঘর বানান এবং আশপাশের কয়েক একর বনভূমি দখল করেন। এর কিছুদিন যেতে না যেতেই দখল করা বনভূমিতে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা শুরু করেন থের। এখন পর্যন্ত ৫০ একর বনভূমি দখল করে ‘জ্ঞানশরণ মহাঅরণ্য বৌদ্ধ বিহার’ নাম দিয়ে ছোটবড় বৌদ্ধ মূর্তি, ভিক্ষু-শ্রমণ ট্রেনিং সেন্টার, কেজি স্কুল, আবাসিক ভবন মিলিয়ে দুই ডজন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন তিনি। বছরের পর বছর ক্রমান্বয়ে বনভূমিতে পাহাড় কেটে পাকা স্থাপনা, রাস্তা নির্মাণ, নলকূপ স্থাপন ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হলেও চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের খুরুশিয়া রেঞ্জের সুখবিলাস বিট অফিস ছিল চুপ।

স্থানীয়দের অভিযোগ, সুখবিলাস বিট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করে ছোট-খাটো স্থাপনা তৈরি করে আসছিলেন শরণংকর থের।

সুখবিলাস বিটের আগের একজন বিট অফিসার দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে বৃহৎ স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেন তিনি। রাঙ্গুনিয়ার শিলক এলাকার বাসিন্দা ওই বিট কর্মকর্তা অবসরোত্তর ছুটিতে গেলেও অফিস করতেন, যাতে বনভূমিতে শরণংকরের স্থাপনা নির্মাণে বিঘ্ন না ঘটে।

এদিকে রাঙ্গুনিয়ায় রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের জায়গা দখল ও ফলাহারিয়া গ্রামে সনাতন সম্প্রদায়ের প্রাচীন শ্মশান দখলেরও অভিযোগ ওঠে শরণংকর থের’র বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে স্থানীয় অধিবাসীরা। গত ১১ অক্টোবর শিলক বাজারে ও ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত পৃথক মানববন্ধন ও  সমাবেশ থেকে আসন্ন দুর্গাপূজার আগেই শরণংকর থেরকে গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০২০
এসকে/এআর/টিসি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।