গাইবান্ধা: গাইবান্ধায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। দলবেঁধে ধর্ষণ ও শিশু-কিশোরদের সম্পৃক্ততায় বাড়ছে উদ্বেগের মাত্রা।
রোববার (১৮ অক্টোবর) সরেজমিন গাইবান্ধা সদর, সাদুল্যাপুর, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গোবিন্দগঞ্জ থানায় খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য মেলে।
এর মধ্যে জেলার সাঘাটা উপজেলায় পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণের মামলায় নয় বছরের এক শিশুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে উপজেলার বোনারপাড়া ইউনিয়নের দুর্গাপুর (কাচারিপাড়া) গ্রাম থেকে শিশুটিকে গ্রেফতার করা হয়।
সাঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বেলাল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, শনিবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে অভিযুক্ত শিশুটি পাঁচ বছরের এক শিশুকে নির্মাণাধীন একটি বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে। শিশুটির চিৎকারে ঘটনার সাক্ষী সাত বছরের দুই শিশু ঘটনাস্থলে আসতে দেখে অভিযুক্ত শিশুটি পালিয়ে যায়। নির্যাতনের শিকার শিশুটিকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
পরে বৃহস্পতিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে নির্যাতনের শিকার শিশুটির বাবা বাদী হয়ে সাঘাটা থানায় ধর্ষণ মামলা করেন। ওইদিন বিকেলে অভিযুক্ত শিশুটিকে গ্রেফতার করে গাইবান্ধা আমলি আদালতে (সাঘাটা) হাজির করা হয়। এসময় আদালতের বিচারক কাজী ফখরুল ইসলাম শিশুটিকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এদিকে জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলায় চার বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে শাওন প্রধান (১৫) নামে এক কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শনিবার (১০ অক্টোবর) রাতে অভিযুক্ত শাওনকে উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের ছোট গয়েশপুর গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে আটক করা হয়। শাওন ওই গ্রামের তাজুল প্রধানের ছেলে।
সাদুল্যাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদ রানা বাংলানিউজকে জানান, শনিবার (১০ অক্টোবর) সকালে উপজেলার ছোট গয়েশপুর গ্রামের একটি বাড়িতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা চলছিল। সেখানে শিশু-কিশোরদের সাউন্ড বক্সে গান শুনতে দেখে ওই শিশুটি সেখানে যায়। এসময় শাওন তাকে ফুসলিয়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণচেষ্টা চালায়। শিশুটি চিৎকার দিলে তাকে ছেড়ে দেয় ওই কিশোর। শিশুটি অসুস্থ হয়ে বাড়িতে গিয়ে বিষয়টি তার মাকে জানায়। পরে শিশুটির মা রাতেই থানায় মৌখিক অভিযোগ দেন ও রোববার দুপুরে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে শাওনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। অভিযুক্ত কিশোর শাওনকে আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
অপরদিকে জেলার গোবিন্দগঞ্জে বিয়ের প্রলোভনে এক তরুণীকে (১৯) ডেকে নিয়ে বাড়িতে দুই দিন আটকে রেখে গণধর্ষণ করে প্রেমিক ও তার বন্ধুরা। এ ঘটনায় আটক প্রেমিকসহ চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) পৌরশহরের শিববাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
অভিযুক্তরা হলেন-পৌর এলাকার চাষকপাড়া গ্রামের আনারুল হকের ছেলে শাহাদত হোসেন (২০) তার সহযোগী ফুলবাড়ী নাচাই কোচাই গ্রামের আব্দুর রহমান সরকারের ছেলে জহুরুল সরকার (২৬), পৌরসভার বোয়ালিয়া (নয়াপাড়া) গ্রামের আব্দুল হামিদের ছেলে জাহাঙ্গীর মিয়া (৩৫), থানাপাড়া (কসাইপাড়া) গ্রামের মৃত ইউনুস আলীর ছেলে জাহিদ হাসান (২৭)।
গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম মেহেদী হাসান বাংলানিউজকে জানান, পৌর এলাকার চাষকপাড়া গ্রামের আনারুল হকের ছেলে শাহাদত হোসেনের সঙ্গে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফরিদপুর জেলার চক হরিরামপুর গ্রামের ওই তরুণীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ওই তরুণীকে নিজ এলাকায় ডেকে আনেন শাহাদত। পরে পৌরসভার শিববাড়ী এলাকার একটি বাড়িতে তাকে আটক রেখে শাহাদত ও তার বন্ধুরা মিলে গণধর্ষণ করেন। একপর্যায়ে ওই তরুণী বাড়ি থেকে কৌশলে বের হয়ে শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় গোবিন্দগঞ্জ থানায় এসে অভিযোগ করেন।
অভিযোগের ভিত্তিতে পৌর এলাকার বিভিন্ন স্থানে রাতভর অভিযান চালিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে অভিযুক্তরা গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (চৌকি) আদালতের বিচারক পার্থ ভদ্রের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
অন্যদিকে গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে প্রতিবেশী দুই যুবকের বিরুদ্ধে। বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে উপজেলা সদরের কিশামত মালিবাড়ী ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সাইফুল ইসলাম (২৫) নামে এক যুবককে আটক করে পুলিশ। সাইফুল মালিবাড়ী ইউনিয়নের এমপির বাজার নয়া গ্রামের এনছের আলীর ছেলে। অভিযুক্ত অপর যুবক হলেন-মালিবাড়ী ইউনিয়নের গিদালটারী গ্রামের নিজামউদ্দিনের ছেলে নুহু (২৪)।
গাইবান্ধা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খান মো. শাহরিয়ার জানান, বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১টার দিকে ঝালমুড়ি খাওয়ানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিবেশী কিশোরীকে নিজ বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায় সাইফুল। পরে একটি ঘরে নুহুসহ দুই বন্ধু মিলে ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে কিশোরীর চিৎকার শুনে কিশোরীর মা ও প্রতিবেশীরা ঘটনাস্থলে গেলে দুই যুবক পালানোর চেষ্টা করলে স্থানীয় লোকজন সাইফুলকে হাতে-নাতে আটক করতে পারলেও নুহু পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন সাইফুলকে পুলিশে সোপর্দ করে। ওই ঘটনায় মেয়েটির বাবা রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার (১ অক্টোবর) দুইজনকে অভিযুক্ত করে গাইবান্ধা সদর থানায় মামলা করেন। পরদিন শুক্রবার ( ২ অক্টোবর) দুপুরে সাইফুলকে আদালতের মাধ্যমে গাইবান্ধা জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপর আসামিকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এছাড়া জেলার ফুলছড়িতে বিয়ের প্রলোভনে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে ফিরোজ কবির (২৮) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) রাতে ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া একাডেমি এলাকার মণ্ডলপাড়া গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে ফিরোজকে আটক করা হয়। ফিরোজ মণ্ডলপাড়া গ্রামের এনামুল হক বকুর ছেলে।
ফুলছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাওছার আলী বাংলানিউজকে জানান, একই এলাকার এক তরুণীকে বিয়ের প্রলোভনে ঢাকায় নিয়ে যান ফিরোজ। সেখানে একটি বাসায় রেখে ধর্ষণ করে পালিয়ে যান ফিরোজ। পরে ওই তরুণী এলাকায় ফিরে বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) থানায় মামলা করলে রাতেই ফিরোজ কবিরকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে আদালতের মাধ্যমে ফিরোজকে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে নির্যাতনের শিকার তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয় বলেও জানান তিনি।
এসব ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গাইবান্ধা জেলা সম্বিলিত সামাজিক আন্দোলনের সদস্য সচিব জাহাঙ্গীর কবির তনু।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে সমাজে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। নারীর প্রতি অবজ্ঞা-নারী বিদ্বেষী হীনমনোভাবাপন্ন ঘৃণিত এক শ্রেণির মানুষ এসব কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। শুধু আইন পাস করলেই হবে না, দ্রুত বিচারিক কার্যক্রম শেষে প্রকাশ্যে এদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। সেসঙ্গে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
গাইবান্ধা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) তৌহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, ধর্ষণ-নারী নির্যাতন বন্ধে প্রচলিত আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। সেলক্ষ্যে গাইবান্ধা সদরসহ সাত উপজেলায় নারী ধর্ষন ও নির্যাতন বিরোধী সমাবেশ করা হচ্ছে। এসব সমাবেশে স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের নেতারাসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি দায়ের করা মামলাগুলো সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০২০
এএটি