ঢাকা, শনিবার, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

প্রস্তুতি শেষ, ভোরের অপেক্ষায় জেলেরা

এস.এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০২০
প্রস্তুতি শেষ, ভোরের অপেক্ষায় জেলেরা

বাগেরহাট: ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে মা ইলিশ রক্ষায় বঙ্গোপসাগরসহ উপকূলের নদ-নদীতে মাছ ধরার ওপর ২২ দিনের (১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর) নিষেধাজ্ঞা শেষ হচ্ছে বুধবার (৪ নভেম্বর) রাত ১২টায়।  

সুন্দরবনেও শুটকির মৌসুম এসে গেছে।

বাগেরহাটের জেলেরা সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতিই নিয়ে রেখেছেন। বৃহস্পতিবার (০৫ নভেম্বর) ভোর হলেই তারা ট্রলারে জাল ও প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা দেবেন। প্রতিবছরই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাগেরহাটের দুই সহস্রাধিক জেলে পাঁচ মাস অবস্থান করেন সুন্দরবনে।  

এছাড়া চট্টগ্রাম, বরগুনা, পিরোজপুর, সাতক্ষীরাসহ কয়েকটি জেলা থেকে আরও হাজার দশেক জেলে শুটকি মৌসুমে সুন্দরবনে যায়। মাত্র পাঁচ মাসে বঙ্গোপসাগর থেকে আহোরিত মাছে বিপুল পরিমাণ শুটকি তৈরি হয় সুন্দরবনের দুবলার চরসহ কয়েকটি চরে। এতে ব্যবসায়ীদের আয়ের পাশাপাশি সরকারও এখান থেকে মোটা অংকের রাজস্ব পায়। তবে দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনে মাছের শুটকি করলেও আর্থিক উন্নতি হয় না কেবল জেলেদের। তারপরও অন্য কাজ না জানায় এবং বাপ-দাদার পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিবছরই অনিশ্চিত যাত্রা করছেন জেলেরা।

জেলেরা জানান, প্রতিবছর শীত আসার আগে থেকে সুন্দরবনে শুটকি উৎপাদন মৌসুম শুরু হয়। আমরা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অসুস্থতা, বাঘ-কুমিরসহ ভয়ঙ্কর জন্তু জানোয়ার ও বিশাল মাছের ভয় উপেক্ষা করে পাঁচ মাস অবস্থান করি সুন্দরবনে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে আমরা যাত্রা শুরু করব সুন্দরবনের উদ্দেশে। পরিবার-পরিজন ছাড়া খেয়ে না খেয়ে মাছ ধরি, শুটকি উৎপাদন করি। কিন্তু তাতে পাঁচ মাসে যে টাকা পাই, তা দিয়ে সংসারই চলে না ঠিকমতো। কষ্টে থাকি সারা বছর।

শরণখোলা উপজেলার জেলে আনোয়ার হোসেন, নুরুল আমিন, দুলাল, মুকুলসহ কয়েকজন বলেন, প্রতি বছর আমরা বিভিন্নভাবে ঋণ করে সমুদ্রে যাই। সরকারিভাবে আমরা কোনো সাহায্য পাই না। সুন্দরবনের বনদস্যু-জলদস্যুর উৎপাত ও মুক্তিপণ আদায় এবং অসাধু বনরক্ষীদের দৌরাত্ম কিছুটা বন্ধ হলেও এখনও সীমাহীন সমস্যায় জর্জরিত আমরা। শুটকি জেলেদের আলাদা তালিকা করে সরকারি সহযোগিতা দেওয়া এখন দাবি।

শুটকি ব্যবসায়ী সৈয়দ শুকুর আলী বলেন, প্রতি বছর শুটকি মৌসুমে ছয়টি জাল, তিনটি ট্রলার ও ২৮ জন কর্মচারী নিয়ে সুন্দরবনে যাই। এ মৌসুমে সাবাড় (বহর) নিয়ে সমুদ্রে যেতে ২০ লাখ টাকার প্রয়োজন। এজন্য ব্র্যাক এনজিও থেকে ১০ লাখ টাকা ও আশা এনজিও থেকে চার লাখ টাকা এবং মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস মেয়াদে বাকি ছয় লাখ টাকা এলাকার মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋন নিয়েছি। পাঁচ মাসে এত টাকা ওঠাতে পারব কিনা, তাও সন্দেহ। সরকারি রাজস্ব, ট্রলার মেরামত, তেল খরচ, জেলেদের ভরণ-পোষণ ও বেতন সব মিলিয়ে আমাদের ব্যবসা জুয়ার মতো অনিশ্চিত। ভালো মাছ ধরা পড়লে লাভ অনেক হবে। কিন্তু যদি মাছ কম পাই, তাহলে অনেক বিপদে পড়তে হয় আমাদের।  

রামপাল সদরের ফরহাদ শেখ, শ্রীফলতলার শাহাজান শিকদার, সিকিরডাঙ্গার জুলফিক্কার গাজী, শ্রীফলতলার মো. জয়নাল শেখ, আনছার শিকদার, আক্কাছ আলী শেখ ও ইউছুব আলী শেখ বলেন, সুন্দরবনে শুটকি উৎপাদনের সময় পরিবার পরিজনের ভরণ-পোষণের জন্য চড়া সুদে টাকা আনতে হয়। পাঁচ মাস পরে এলাকায় এসে সুদে আনা টাকা প্রায় দুই থেকে চার গুণ বেশি দিয়ে পরিশোধ করতে হয়। সুন্দরবনে আমরা নিয়মিত। আর আমরা যারা যাই, তারা প্রতিবছরই যাই। সুন্দরবনে যাওয়ার আগে সরকার স্বল্প সময়ের জন্য আমাদের সামান্য কিছু টাকা বিনা সুদে সহযোগিতা করলে আমাদের খুব উপকার হতো।  

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষা কবজ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মায়ের মতো আগলে রেখেছে। মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন কারণে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবন।  

জেলেরা যাতে বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে শুটকির জন্য মৎস্য আহরণ করতে পারেন, সেজন্য বন বিভাগের ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি জেলেদের আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ারও দাবি জানান তিনি।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, শীতে করোনার প্রকোপ বাড়বে। তাই জেলেদের বাধ্যতামূলক মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের শর্ত দিয়ে সাগরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি। এছাড়া প্রত্যেক ট্রলারে প্রাথমিক চিকিৎসা বক্স রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। করোনা বিধিনিষেধের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য দুবলা ফিসারম্যান গ্রুপের নেতৃবৃন্দকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।  

এখানকার শুটকি থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই কোটি ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮১৯ টাকা এবং ২০১৯-২০ সালে অর্থবছরে দুই কোটি ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ০৪৮ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে তিন কোটি ২০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বন বিভাগ।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০২০
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।