ঢাকা, শুক্রবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

আগরতলা থেকে স্বাধীন বাংলার কর্নেল শওকত আলী

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০২০
আগরতলা থেকে স্বাধীন বাংলার কর্নেল শওকত আলী

ঢাকা: বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ও কর্মময় জীবনের অধিকারী ছিলেন কর্নেল (অব.) শওকত আলী। তার জীবনের বড় ঘটনা ও বড় পরিচয় ছিল তিনি ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে অভিযুক্ত ছিলেন।

স্বাধীন দেশেও একাধিকবার তিনি জেল জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করেছেন।

শওকত আলী ১৯৩৭ সালের ২৭ জানুয়ারি শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার লোনসিং বাহের দীঘিরপাড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মুন্সী মোবারক আলী এবং মা মালেকা বেগম। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সনদপ্রাপ্ত হন এবং ১৯৭৮ সালে সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যপদ লাভ করেন।

শওকত আলী ২৪ জানুয়ারি ১৯৫৯ তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অর্ডন্যান্স কোরে কমিশন লাভ করেন। পেশাগত দক্ষতা বিবেচনা করে তাকে করাচির পাশে মালির ক্যান্টনমেন্টে অর্ডন্যান্স স্কুলের প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয়।

ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বিপ্লবী পরিষদের সদস্য ছিলেন শওকত আলী। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মালির ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১৯৬৮ সালের ১০ জানুয়ারি গ্রেফতার হন তিনি। এসময় ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রায় ১৩ মাস কারাগারে ছিলেন। সে বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন শওকত আলী। এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ১৯৬৯ সালে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি প্রথমে মাদারীপুর এলাকার কমান্ডার এবং পরে দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে সাব-সেক্টরের কমান্ডার ও প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন। মুজিবনগর সশস্ত্রবাহিনীর সদর দপ্তরের স্টাফ অফিসারের দায়িত্ব পালনও করেছেন দীর্ঘদিন। আর মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন শওকত আলী।

তিনি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু খুন হওয়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান। তবে অবসরের সময় শওকত আলী কর্নেল পদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে অর্ডন্যান্স সার্ভিসেসের পরিচালক নিযুক্ত হন। এছাড়া দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি পাঁচবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শান্তি আন্দোলনেও তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনীতি: কর্নেল শওকত আলী ১৯৭৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং এই সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। প্রজন্ম-৭১’র জন্মলগ্ন থেকে এই সংগঠনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা। তিনি আফ্রো-এশীয় গণসংহতি সংস্থার (আপসো) কেন্দ্রীয় কমিটির এবং বিশ্ব শান্তি পরিষদ বাংলাদেশ শাখার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। শওকত আলী মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলেন এবং বর্তমানে এই সংগঠনের চেয়ারম্যান। তিনি ১৯৭৮ সালে তিন বছরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

শওকত আলী ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে তিনি আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল তথা বিরোধী দলের হুইপ হিসেবেও কাজ করেছেন। ১৯৮২ সালের মে মাস থেকে ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৬ মাস স্বৈরাচারী শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে কারাবরণ করেন তিনি।

১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বেসরকারি সদস্যদের বিল এবং বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত কমিটি এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া ঐ সংসদে পিটিশন কমিটি, সরকারি হিসাব কমিটি এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

জুন ১৯৯৬-এ সপ্তম ও ২০০১ সালে অষ্টম সংসদে তিনি পুনরায় সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নবম সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারী তিনি সর্বসস্মতিক্রমে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৩ সালের ২২ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন।

শওকত আলী রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য আঞ্জু মোনোয়ারা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন থেকে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্বর্ণপদক পেয়েছেন গুণী এই ব্যক্তি। দেশের প্রতি তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মাদার তেরেসা রিসার্চ কাউন্সিল থেকে তিনি মাদার তেরেসা গোল্ডমেডেল লাভ করেন।

এছাড়া আগরতলা মামলার উপর বাংলায় ‘সত্য মামলা আগরতলা’ ও ইংরেজিতে ‘আর্মড কোয়েস্ট ফর ইনডিপেন্ডেন্স’ এবং কারাজীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ‘কারাগারের ডায়েরী’ শীর্ষক বই লিখেছেন শওকত আলী। ২০১২ সালে তিনি ‘বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম ও আমার কিছু কথা’ এবং ২০১৬ সালে ‘গণপরিষদ থেকে নবম সংসদ’ শিরোনামে তথ্যবহুল বই রচনা করেন; যা বাংলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০২০
এসকে/এইচএমএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ