ঢাকা, শুক্রবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

১৫ আগস্ট প্রাণে বেঁচে যাওয়া রাজিয়া নাসেরের সংগ্রামী জীবন

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০২০
১৫ আগস্ট প্রাণে বেঁচে যাওয়া রাজিয়া নাসেরের সংগ্রামী জীবন

ঢাকা: ১৫ আগস্ট বাবা-মাসহ পরিবারের সবাইকে হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে মাতৃস্নেহে আগলে রাখেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ শেখ আবু নাসের-এর স্ত্রী ও শেখ হাসিনার চাচি শেখ রাজিয়া নাসের।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতার সঙ্গে ঘাতকদের হাতে নিহত হন রাজিয়া নাসের স্বামী শেখ আবু নাসের।

এদিন সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বাঁচলেও সংগ্রামী জীবনে রাজিয়া নাসের পার করেছেন কঠিন কষ্টের সময়, মুখোমুখি হয়েছেন মৃত্যুর।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আর্মি শেখ আবু নাসেরের টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পরে সন্তানদের নিয়ে ঢেকিঘরে আশ্রয় নেন শেখ রাজিয়া নাসের। রাজাকাররা জানতে পারে যে শেখ নাসেরের পরিবার ঢেকিঘরে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে গিয়ে তারা সেটিও পুড়িয়ে দেয়। পুড়িয়ে দেওয়ার সময় শেখ রাজিয়া নাসের তার সন্তান শেখ রুবেলকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। ফিডারটি কেড়ে নিয়ে রাজাকাররা ভেঙে ফেলে। এ সময় কৌশলে তিনি সন্তানদের নিয়ে জীবন বাঁচান।  

শেখ আবু নাসের ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ছেলে শেখ হেলাল ও ভাতিজা শেখ জামাল তারাও শেখ নাসেরের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন নয় নম্বর সেক্টরে। শেখ হেলাল ও শেখ জামাল ছোট থাকার কারণে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোলাবারুদ সরবরাহ করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিতেন এবং তাদের অস্ত্রের গুলি লোড করে দিতে সাহায্য করতেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে শেখ নাসের ভারতে চলে যান। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে সুন্দরবন এলায় সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে খুনিরা শেখ আবু নাসেরকেও হত্যা করে। পরের দিন ১৬ আগস্ট যখন টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতাকে দাফন করা হচ্ছে শেখ রাজিয়া নাসের সন্তানদের নিয়ে লঞ্চে করে খুলনা থেকে টুঙ্গিপাড়ায় আসেন। কিন্তু খুনিচক্র টুঙ্গিপাড়ায় সেই লঞ্চ ভিড়তে দেয়নি। পরে সন্তানদের নিয়ে লঞ্চে করে আবার খুলনায় ফিরে আসেন। বাড়িতে ফিরে এসে তিনি দেখেন সরকার তার বাড়ি সীলগালা করে রেখেছে। সেদিন শতচেষ্টা করেও নিজের বাড়িতে ঢুকতে পারেননি তিনি। এক পর্যায়ে বাচ্ছাদের নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। পরে সন্তানদের নিয়ে রাতে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন। তখন শেখ রাজিয়া নাসের প্রায় সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।  

বাবার বাড়িতেও খুনিরা তাকে থাকতে দেয়নি। তার বাবার ওপর নানাভাবে চাপ দিতে থাকে বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্ররা। একপর্যায় সেখানে টিকতে না পেরে পাবনায় দাদার বাড়িতে চলে যান রাজিয়া নাসের। কিন্তু সেখানেও বিভিন্নভাবে হয়রানির স্বীকার হন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা হয় না। স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয়নি। তখন বড় ছেলে শেখ হেলাল ক্যাডেট কলেজে পড়তেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্যাডেট কলেজে একটা গ্রুপ হানা দেয় শেখ হেলালকে তুলে আনার জন্য। কিন্তু শিক্ষক ও ছাত্রদের বিশেষ করে ক্যাডেট কলেজের সেই সময়কার প্রিন্সিপালের বাধার মুখে শেখ হেলাল রক্ষা পায়।  

সন্তানদের নিয়ে দাদার বাড়ি থেকে শেখ রাজিয়া নাসের আবার খুলনায় ফিরে এসে মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকেন সাত সন্তানদের নিয়ে। বড় মেয়ে মিনা ও ছেলে শেখ জুয়েলকে খুলনা সরকারি স্কুলে ভর্তি করনো হলেও জিয়া সরকারের নির্দেশে স্কুল থেকে তার সন্তানদের নাম কেটে দেয়। এতে বন্ধ হয়ে যায় তার সন্তানদের লেখাপড়া। তাদের পারিবারিক ব্যবসাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে সন্তানদের নিয়ে নিদারুণ অর্থ কষ্টে পড়েন শেখ রাজিয়া নাসের। অবশেষে ১৯৮১ সালে তার বাড়ির সীলগালা খুলে দেওয়া হয়। পরে তিনি সন্তানদের নিয়ে সেখানে উঠেন। ইতোমধ্যে ছেলে শেখ হেলাল ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

শেখ রাজিয়া নাসের অত্যন্ত প্রগতিশীল ও সংস্কৃতি মনা ছিলেন। তিনি সেই সময় খুলনায় সঙ্গীত প্রতিযোগীতায় প্রথম হতেন। এ মহীয়সী নারীর ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসের এর সঙ্গে বিয়ে হয়।  

রাজিয়া নাসের এর বড় ছেলে বাগেরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) শেখ হেলাল উদ্দিন ও খুলনা-২ আসনের এমপি শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল, নাতি বাগেরহাট-২ আসনের এমপি শেখ সারহান নাসের তন্ময়। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার চাচি রাজিয়া নাসের।

১৯৭৭ সালে বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা লন্ডন থেকে বেবী সিজারের কাজ করে জমানো টাকা দিয়ে তার চাচি ও ভাই-বোনদের জন্য শীতের কাপড়সহ প্রথম সহায়তা পাঠান।  

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন ভারতের দিল্লি ছিলেন। এরপর তিনি সেখান থেকে তার চাচিসহ ভাই-বোনদের জন্য সহায়তা পাঠিয়ে ছিলেন।
  
১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তার চাচি রাজিয়া নাসের তাকে মাতৃস্নেহে আগলে রাখেন। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অভিভাবক।

রাজিয়া নাসের সোমবার (১৬ নভেম্বর) রাত ৮টা ৫০মিনিটে রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে বাধ্যর্কজনিত কারণে মারা যান (ইন্নালিল্লাহি .... রাজিউন)। গত ৩ নভেম্বর থেকে তিনি ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

মঙ্গলবার (১৭ নভেম্বর) বাদ জোহর বনানী কবরস্থানে জানাজা শেষে সেখানেই রাজিয়া নাসেরকে দাফন করা হয়।

বনানী কবরস্থানে স্বামীসহ ১৫ আগস্টের অন্য শহীদদের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ শেখ আবু নাসের-এর স্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচি শেখ রাজিয়া নাসের।

** রাজিয়া নাসেরের দাফন সম্পন্ন 
** প্রধানমন্ত্রীর চাচি রাজিয়া নাসের আর নেই

বাংলাদেশ সময়: ২০০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০২০
এমইউএম/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ