ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘চোখের সামনে ভেসে গেল ঘর’

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২১
‘চোখের সামনে ভেসে গেল ঘর’

লালমনিরহাট: তিস্তা নদীর হিংস্রো স্রোতে চোখের সামনে ভেসে গেছে থাকার ঘর। খোলা আকাশের নিচে সন্তানদের নিয়ে দীর্ঘশ্বাস শরিফার।

শরিফা বেগম লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের বারঘড়িয়া চেয়ারম্যানের মিল এলাকার দিনমজুর আলম মিয়ার স্ত্রী।

শরিফা বেগম জানান, একাধিক বার তিস্তার কড়াল গ্রাসে বসতভিটা হারিয়ে মহিষখোচা বাজার থেকে সলেডি স্প্যার বাঁধ সড়কের ভাটিতে ৮ শতাংশ জমি বন্দক নিয়ে দুইটি ঘর করে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতেন শরিফা আলম দম্পতি। বুধবার (২০ অক্টোবর) সকালে তিস্তা পাড়ে হঠাৎ বন্যা দেখা দেয়। তাদের বাড়িতেও পানি উঠে। দিন যতোই বাড়ে ততই বাড়তে থাকে বন্যার পানি। পানিবন্দি হয়ে পড়েন তারা। সন্ধ্যার পর পানির চাপ বেড়ে গেলে সড়ক উপচে পানির স্রোত বইতে শুরু করে। তখন হাঁস, মুরগি ও সন্তানদের নিয়ে দ্রুত সড়ে যান নিরাপদ স্থানে।

সেখানে খোলা আকাশের নিচে কাটে তাদের রাত। পরদিন সকালে সড়ক ভেঙে তাদের বাড়ির ওপর দিয়ে বয়ে তিস্তার হিংস্রো স্রোত। চোখের সামনে ভেসে যায় দুই দুইটি ঘর ও সকল আসবাবপত্র। মায়া কান্না ছাড়া কিছুই করার ছিল না শরিফা আলম দম্পতির।  

সড়কের পাশে খোলা আকাশে সন্তানদের নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শরিফা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘বানের পানি নেমে গেলে সবাই ঘরে যাচ্ছে। হামার ঘরও তো ভাসি গেলো বানের পানিত। কোথায় থাকমো, কি খামো আল্লায় জানে। অসময়ে এতো বড় বান হইবে স্বপ্নেও ভাবি নাই। ’

এমন পরিণতি শুধু শরিফার নয়। একই গ্রামের ওয়াবদা বাঁধের ভাটিতে বসবাস করা দিনমজুর আব্দুল হাই, ফজু মিয়া ও তাজুলসহ অনেকের ঘর বাড়ি বন্যার পানির চাপে ভেসে গেছে। কিছুই রক্ষা করতে পারেনি তারা। অসময়ের এ বন্যার ছোবলে লণ্ডভণ্ড হয়েছে তিস্তা পাড়ের কাচা-পাকা রাস্তা, গাছপালা ও ঘর বাড়ি।

বারঘড়িয়া গ্রামের তাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ঘরেই ছিলাম। স্রোত বেড়ে গেলে প্রথমে ঘরের বেড়াগুলো ভেসে যায়। এরপর থাকা অনিরাপদ দেখে সন্তানদের নিয়ে ঘর থেকে বাহিরে বেরিয়ে পড়ি। নয়তো জীবনও চলে যেতো। এমন বন্যা জীবনে দেখি নাই। ঘরের সবকিছু ভেসে গেছে। কিছু বাঁচাতে পারি নাই।

উজানের ঢেউয়ের প্রথম আঘাত পড়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়নে। সেখানেও পানিবন্দি হয়ে পড়ে ইউনিয়নটির প্রায় দেড় হাজার পরিবার। তাদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করে উপজেলা প্রশাসন।

পাটগ্রাম উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার নন্দি রায় বাংলানিউজকে বলেন, দহগ্রাম ইউনিয়নে প্রায় দেড় হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। প্রতিটি পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ঘর বাড়ির তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও উৎতি ফসলের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

এদিকে গত বন্যার পানির চাপে ভেঙে গেছে কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা রংপুর সড়ক, তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড বাইপাস সড়কসহ কাচা পাকা বিভিন্ন সড়ক। বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে যাওয়ায় অনেক এলাকা অন্ধকারে রয়েছে। বন্যার ছোবলে ভেঙ্গে যায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ওয়াব্দা। সদ্য সংস্কার করা আদিতমারী উপজেলার কুটিরপাড় থেকে বারঘড়িয়া ওয়াব্দা বাঁধটি মোহাম্মদ হোসেন চেয়ারম্যানের মিলের পশ্চিমে ভেঙে গেছে। ধসে গিয়ে বাঁধটির অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

বুধবারের সৃষ্ঠ বন্যার ২৪ ঘণ্টায় উন্নতি ঘটলেও কৃষিতে সর্বাধিক ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয়দের দাবি। উৎতি ফসল পাকা ও আধাপাকা আমন ধান বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে। নষ্ট হয়েছে শত শত হেক্টর বাদাম, আলুসহ নানান সবজি ক্ষেত। ভেসে গেছে শত শত পুকুরের মাছ। সবমিলে কৃষক আর মৎস চাষিদের স্বপ্ন ভেঙেছে অসময়ের এ বন্যায়।

এর আগে, বুধবার (২০ অক্টোবর) সকালে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারেজ ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করে তিস্তার পানি প্রবাহ। বেলা ১২টায় এ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তিস্তা নদীর পানি। ফলে ভয়াবহ বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়ে লালমনিরহাটের লাখো মানুষ। এর ২৪ ঘণ্টা পরে বৃহস্পতিবার দুপুরে বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার নিচে নেমে আসে তিস্তার পানি প্রবাহ। ফলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বাংলানিউজকে বলেন, বন্যার্তদের জন্য ৭০ মেট্রিক টন চাল ও ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। পানি কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থির উন্নতি ঘটেছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

>>> তিস্তার পানি বিপৎসীমার নিচে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি

বাংলাদেশ সময়: ১০০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২১
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।