ঢাকা, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ মে ২০২৪, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

নদীর লোনা পানি খাচ্ছে লক্ষ্মীপুরের কয়েক হাজার মানুষ

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৪ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২২
নদীর লোনা পানি খাচ্ছে লক্ষ্মীপুরের কয়েক হাজার মানুষ

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়নের মজুচৌধুরীর হাটের পশ্চিমে মেঘনা নদীতে জেগে ওঠা বেশ কয়েকটি চরে গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে মানুষ বসবাস করে আসছে। সেখানে কয়েক হাজার মানুষ স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে কৃষি কাজ ও গবাদি পশু পালন করে আসছে।

এসব বাসিন্দারা তাদের প্রতিদিনের পান করার পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন নদীর পানি দিয়ে।

দুর্গম চরগুলোগুলোতে কোনো সুপেয় পানির ব্যবস্থা না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে নদীর লোনা জল পান করছেন। তবে সে পানি পান করার আগে ফিটকিরি দিয়ে শোধন করে নিচ্ছেন এসব বাসিন্দারা।  

জেলার কমলনগরের মতিরহাট থেকে উত্তর পশ্চিমে থাকা এমন একটি চরে বসবাস কৃষক মনির হোসেনের। দুর্গম এবং বিচ্ছিন্ন এ চরটি জেলার সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। মূল ভূখণ্ড থেকে অন্তত্য ৫ কিলোমিটার দূরের এ চরে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা।  

বিগত ১৫ বছর থেকে এ চরে পরিবার পরিজন নিয়ে মনির হোসেনের বসবাস। তার মতো আরও প্রায় ১৮টি পরিবার এ চরে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করে আসছেন। তাদের সবারই পান করার একমাত্র ভরসা নদীর পানি।  

মনির বাংলানিউজকে বলেন, চরের কোথায় গভীর নলকূপ তো দূরের কথা, অগভীর নলকূপও নেই। তাই আমরা নদীর পানি নিয়ে তাতে ফিটকিরি দিয়ে শোধন করে নিই। সেগুলোই রান্না এবং খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করি।  

তিনি বলেন, এখন নদীর পানির অবস্থা ভালো। কিন্তু যখন নদীতে অতিরিক্ত জোয়ার থাকে, তখন পানিতে লবনাক্ততা বেশি থাকে। ওই পানি ফিটকিরি দিলেও লোনা থেকে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে লোনা পানি পান করতে হয়।  

তিনি জানান, মাঝে মধ্যে চরের শিশুরা ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। গত কয়েক বছরে বেশ কিছু শিশুকে চাঁদপুর ডায়রিয়া হাসপাতালেও নিতে হয়েছে।  

ওই চরে বসবাসকৃত মনির হোসেনের আরও কয়েকজন বাসিন্দা সুপেয় পানির অভাবের কথা জানান।  



মজুচৌধুরীর হাটের পশ্চিমে থাকা আরেকটি চরে বসবাস করেন মজিবুল মোল্লা নামে আরেক কৃষক। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনি সেখানে গত ৫ বছর থেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন। শুরু থেকেই নদীর পানি পান করতে হতো তাকে। গত তিন মাস আগে তিনি ঘরের পাশে একটি অগভীর নলকূপ বসিয়ে নিয়েছেন। তবে ওই নলকূপের পানি আর্সেনিকমুক্ত কিনা- সেটা নিশ্চিত নয় চরের এসব সাধারণ কৃষকরা।  

মজিবুল মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, পানির জন্য খুব কষ্ট করতে হতো। বসতবাড়ি থেকে নদী কিছুটা দূরে। তাই নদীর পানি বহন করে আনটাও কিছুটা কষ্টসাধ্য ছিলো। সেজন্য একটি অগভীর নলকূপ বসিয়ে নিয়েছি।  

অগভীর নলকূপে আর্সেনিক
সুপেয় পানির অভাব যে শুধু চরে রয়েছে তা নয়- সমতল এলাকাতেও চরম সংকট সুপেয় পানির। প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দাদের একমাত্র ভরসা অগভীর নলকূপের পানি।
 
জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল থেকে যে গভীর নলকূপগুলো দেওয়া হয়- সেগুলো শুধুমাত্র প্রভাবশালী কিংবা তাদের আস্থাভাজনদের ভাগ্যেই জোটে। ফলে বেশিরভাগ বাসিন্দারা সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।  

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য মতে, অগভীর নলকূপের মধ্যে ৯৫ শতাংশ নলকূপে আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে।  

সদর উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নের ছিলাদী গ্রামের বাসিন্দা দেলোয়ারা বেগম বলেন, আমরা যে অগভীর নলকূপ থেকে পানি পান করছি- সেগুলো লোনাযুক্ত। পানিতে আর্সেনিক আছে কিনা- তা জানি না। গত বছর বাড়ির একটি পরিবারের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। নলকূপের বরাদ্দ আনতে মোটা অংকের অর্থ খরচ হওয়ায় ওই পরিবারের লোকজন বাড়ির অন্য লোকদের পানি নিতে দিচ্ছে না। বাড়ির অদূরে থাকা একটি অগভীর নলকূপ থেকে মাঝে মধ্যে পানি নিয়ে আসি।  



নিম্নবিত্ত পরিবারের এ নারীর মতে, প্রয়োজনীয় অর্থ এবং জনপ্রতিনিধির দারস্থ না হতে পারায় গভীর নলকূপ স্থাপন তাদের জন্য সহজলভ্য নয়।  

এদিকে নদীর উপকূলীয় এলাকার বেশিরভাগ অগভীর নলকূপের পানি লোনাযুক্ত।  

কমলনগর উপজেলার চরমার্টিন এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের এলাকায় বেশিরভাগ অগভীর নলকূপ। এসব কলের পানিতে আর্সেনিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়নি। তবে এলাকাটি মেঘনা নদীর উপকূলীয় অঞ্চলে হওয়ায় অনেক নলকূপ থেকে লোনা পানি বের হচ্ছে। সরকারিভাবে দেওয়া গভীর নলকূপ স্থাপন সহজলভ্য না হওয়ায় আর্সেনিক বা লোনা পানি পান করতে হচ্ছে। ফলে চরাঞ্চলের মানুষ এখনো সুপেয় পানির সংকটে আছে।  

এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী ফাতেমাতুজ জোহরা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা প্রত্যেকটি অগভীর নলকূপের পানি পরীক্ষা করছি। ৯৫ শতাংশ অগভীর নলকূপ এবং শ্যালো টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। যা পান করার অনুপোযোগী।

তিনি বলেন, সমগ্র বাংলাদেশ নিরাপদ পানি প্রকল্পের আওতায় প্রতি বছর প্রত্যেকটা ইউনিয়নের জন্য ৫২টা করে গভীর নলকূপের বরাদ্দ আসে। এছাড়া আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন প্রকল্পে নলকূপের বরাদ্দ আসবে। মুজিববর্ষে গৃহহীনদের জন্য গভীর নলকূপের বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা সে বরাদ্দ বন্টন করে, আমরা শুধু সেগুলো বাস্তবায়ন করি।

ফাতেমাতুজ জোহরা বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী গভীর নলকূপের পরিমাণ একেবারে কম। তবে নদীর বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের মানুষের জন্য গভীর নলকূপের ব্যবস্থা করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২২
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।