ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পাহাড় ধসের হরেক কারণ

আলম শাইন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০২৩
পাহাড় ধসের হরেক কারণ

পাহাড়—পর্বত—জলাশয়—বনবনানী প্রকৃতির বিশেষ দান বা আশীর্বাদ। যে দানে প্রকৃতির স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা নেই।

পৃথিবীর সমগ্র প্রাণিকুলের জন্যই প্রকৃতি এই বিশেষ দান সমবণ্টন করে রেখেছে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি প্রাণীই প্রকৃতিকে নানাভাবে ভোগ করে আসছে লক্ষ—কোটি বছর ধরে। হতে পারে সেটি জলবায়ু গ্রহণের মাধ্যমে, হতে পারে খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে, কিংবা হতে পারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের মাধ্যমে। অর্থাৎ প্রাণিজগৎকে টিকে থাকতে হলে প্রকৃতির স্বাদ আস্বাদনের বিকল্প নেই।

আমরা আগেই বলেছিলাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করাও প্রকৃতিকে ভোগ করার সমতুল্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিভিন্নভাবেই ভোগ করছে মানবজাতি। যেমন, নদ—নদী, সমুদ্র দর্শন, বন—জঙ্গল দর্শন, পাহাড়—পর্বত দর্শন ইত্যাদি। এই বাহারি সৌন্দর্য দর্শনে শুধু আনন্দই পাচ্ছেন না মানুষ, বেঁচে থাকার উপাদানও খুঁজে পাচ্ছেন। যেমন, পাহাড়—পর্বতের কথাই ধরা যাক, পর্বত শুধু সৌন্দর্যেরই প্রতীক নয়, এর থেকে অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হচ্ছেন মানুষ। সেসব কথায় আমরা পরে আসছি। তার আগে আমরা জেনে নেই পাহাড়ের গুরুত্ব পৃথিবীর জন্য কতটা প্রয়োজনীয়।

পাহাড় বা পর্বতশ্রেণিকে বলা হয় প্রকৃতির পেরেক। ভূমিকম্প প্রতিরোধক বললেও ভুল হবে না। আমরা জানি, পৃথিবীটা হচ্ছে লাটিম সাদৃশ্য ঘূর্ণায়মান একটা গ্রহ। সৌরজগতের বিশেষ একটা নক্ষত্র সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত বনবন করে ঘুরছে পৃথিবী। সব গ্রহ ও নক্ষত্রমণ্ডলীকে প্রকৃতি এমনভাবে নিজস্ব কক্ষপথে স্থাপন করে দিয়েছে যে তাতে এক চুল পরিমাণও এদিক সেদিক হওয়ার সুযোগ নেই। ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রকৃতি বিভিন্ন গ্রহকে বিভিন্নভাবে স্থাপন করেছেন, আবার সহায়ক কোনো বস্তুকে গ্রহের অভ্যন্তরে সেঁটেও দিয়েছেন। পৃথিবীর সহায়ক বস্তু হিসেবে পাহাড়—পর্বতমালা সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টিকর্তা। আমরা রহস্যময় সেই সৃষ্টি সম্পর্কে সামান্য ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি আগে, তার পরে বিস্তারিত।

ভূতত্ত্ববিদদের মতে, ‘ভারী ভারী বৃহদাকার প্লেটগুলো পৃথিবীর ওপরের শক্ত স্তর সৃষ্টি করে, সেগুলোর নড়াচড়া আর সংঘর্ষের ফলেই উৎপত্তি ঘটে পর্বতমালার। দুটি প্লেট যখন পরস্পর ধাক্কা খায় তখন শক্তিশালী প্লেটটি অন্য প্লেটের নিচে গড়িয়ে চলে যায়। তখন ওপরের প্লেটটি বেঁকে গিয়ে পর্বত ও উঁচু উঁচু জায়গার জন্ম দেয়। নিচের স্তরটি ভূমির নিচে অগ্রসর হয়ে ভেতরের দিকে এক গভীর প্রসারণের জন্ম দেয়। এর মানে পর্বতের রয়েছে দুটি অংশ। ওপরে সবার জন্য দর্শনযোগ্য একটি অংশ থাকে। তেমনি নিচের দিকে গভীরে এর সমপরিমাণ বিস্তৃতি রয়েছে। ’

পর্বতগুলো ভূমির ওপরে ও ভূমির গভীরে বিস্তৃত হয়ে পেরেকের মতো ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন প্লেটকে দৃঢ়ভাবে আটকে ধরে রাখে। পর্বতগুলো দৃঢ়ভাবে ধরে রাখার বৈশিষ্ট্যই ভূপৃষ্ঠের ওপরের স্তরের ভূকম্পন প্রতিরোধ করে অনেকাংশেই। সুতরাং বলা যায়, পর্বতমালা হচ্ছে পৃথিবীর জন্য বিশাল একটা রক্ষাকবচ। অথচ ওই রক্ষাকবচটাকেই মানুষ নানাভাবে তছরূপ করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়গুলোর রক্ষণাবেক্ষণ না করে বরং পাহাড় কেটে সমতল বানাচ্ছে। তছরুপ করে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে মানুষ। বিভিন্নভাবেই মানুষ পাহাড়ের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে আসছে যুগযুগ ধরে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পাহাড়—পর্বতগুলো তছরুপের শিকার হচ্ছে। তার মধ্যে বৃক্ষনিধন ও মাটিকাটা অন্যতম। যার ফলে বর্ষা এলেই পাহাড়ি অঞ্চলে বিশেষ করে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট অঞ্চলে দুর্যোগ নেমে আসে। অতিবর্ষণে পাহাড়ের মাটির ধস নেমে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।

পাহাড়ধস নামে মূলত বর্ষা এলেই; প্রতিবছরই এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট অঞ্চলে। পরিসংখ্যানে জানা যায়, পাহাড়ধসের ঘটনায় গত ১৫ বছরে শুধু চট্টগ্রাম জেলাতেই প্রাণহানি ঘটেছে ৩ শতাধিকের বেশি। তার মধ্যে ১১ জুন, ২০০৭ সালে ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনাটি ঘটে। ওই ঘটনায় ১২৭ জনের প্রাণহানির সংবাদ জানা গেছে। অপরদিকে ২০১৭ সালে তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ধসে ১৫৬ জনেরও বেশি মানুষ মারা যান। ওই ঘটনায় ৪ জন সেনাসদস্যও প্রাণ হারান; তারা তখন সেখানে উদ্ধার কাজেই নিয়োজিত ছিলেন। ২০২৩ সালে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ব্যাপক প্রাণহানির সংবাদ জানা গেছে।  

বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় পাহাড়ধসের কয়েকটি কারণ জানা যায়; তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, পাহাড়ের মাটি কেটে নেওয়া। অবাধে বৃক্ষনিধন। অপরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণের কারণে পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে দেওয়া। তার ওপরে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে বসতি গড়ে তোলা। যার ফলে ভূতাত্ত্বিক গঠন নষ্ট হয়ে পাহাড় ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই বিপর্যয়ের সঙ্গে আবার অতিবৃষ্টি যোগ হয়ে পাহাড় ধসে পড়ছে। ভূমিকম্পের কারণেও পাহাড়ের ধস নামে; তবে আমাদের দেশে সেরকম ঘটনা এখনও ঘটেনি। আবার প্রয়োজনে ডিনামাইট ফাটিয়েও পাহাড়ের ধস নামানো হয়, সেসবও আমাদের দেশে ঘটেনি। আমাদের দেশের কিছু অসাধু মানুষ ইটভাটার প্রয়োজনে মাটি কেটে এবং ভূমিদস্যুরা পাহাড় দখল করে সমতল বানানোর প্রচেষ্টায় অথবা কৃষিকাজের প্রয়োজনে মাটি কেটে নেওয়ায় পাহাড়গুলো ধসে পড়ছে। দেখা গেছে, পাহাড়ের মাটি কাটার দরুন প্রবল বর্ষণে মাটির স্তরে স্তরে জলের স্রোত প্রবেশ করে পাহাড়ের মাটিকে গলিয়ে ফেলে, অথবা ফাটল সৃষ্টি করে নিচের দিকে ধসে পড়ে।  

উল্লেখ্য, পাহাড়ের মাটি ওপরের দিকে যতটা শক্ত অনুভূত হয় ভেতরটা ততটা শক্ত নয়। আমাদের দেশের পাহাড় বেশিরভাগই দো—আঁশ মাটির। বেলে পাথরের পাহাড় থাকলেও সেসব পাহাড়ের সংখ্যা ততটা নয়। আবার কিছু পাহাড় আছে শুধুই মাটি আর বালু দিয়ে গঠিত। আরেক ধরনের পাহাড় আছে, বিভিন্ন স্তরে মাটি ও বালুর মিশ্রণে তৈরি। পার্বত্য এলাকার উত্তর—দক্ষিণ দিকে পাহাড়গুলো অধিকাংশ মাটি ও বালুর মিশ্রণে গঠিত। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় পাহাড় কেটে সেখানে বসতি স্থাপনও করছে এখন স্থানীয়রা। ফলে পাহাড় আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

পাহাড় ধসের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, বনভূমি উজাড় হওয়া। বৃক্ষরাজির বিস্তৃতি কমে যাওয়া এবং মাটি ঝুরঝুরে হওয়ায় বৃষ্টিজলে পাহাড়গুলোতে ফাটল সৃষ্টি হয়ে ধসে পড়ছে। আবার প্রাকৃতিক বন কেটে গজারি, সেগুন, রাবার ও ফলবাগান তৈরি করার কারণেও পাহাড় ধসে পড়ছে। দেখা গেছে, এই গাছগুলোর শিকড়ের বিস্তৃতি কম, তেমন শক্তিশালীও নয়, মাটি আঁকড়ে ধরে রাখতে পারছে না। ফলে মাটি আলগা ও শুকনো হয়ে যাচ্ছে। ওই মাটি বেয়ে অতিবৃষ্টির স্রোত নামার কারণেও পাহাড় ধসে যাচ্ছে। এ ছাড়াও ঝিরি—ঝর্ণার গতিপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ফলেও পাহাড়ে বিপর্যয় নেমে আসছে। যেই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে আমাদের উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে শিগগিরই। এমতাবস্থায় প্রথমত আমাদের করণীয় হচ্ছে, দেশের সব ন্যাড়া পাহাড়গুলোকে সবুজে মুড়িয়ে দেওয়া। পাহাড়ের জন্য পরিবেশবান্ধব বনায়ন গড়ে পাহাড়গুলোকে সতেজ করে তোলা। তার সঙ্গে অবশ্যই যা করতে হবে, সেটি হচ্ছে পাহাড় কাটা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। উন্নয়ন কাজের জন্য পাহাড় কাটতে হলে অর্থাৎ রাস্তাঘাট নির্মাণ করতে হলে, অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে তা করতে হবে। পাশাপাশি ঝিরি—ঝর্ণাগুলোর গতিপথও ঠিক রাখতে হবে, তবেই পাহাড় ধস রোধ করা সম্ভব হবে, নচেৎ প্রকৃতির এই পেরেকগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে অচিরেই। আর তাতে পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে যাবে। এমনিই তো জুমচাষের কারণে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের সম্মুখীন। তার ওপরে পাহাড় ধসে পড়লে পাহাড়ের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে একদিন। সুতরাং প্রকৃতিকে বাঁচাতে হলে আগে পাহাড়গুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে আমাদের। কারণ পাহাড় শুধু ভূমিকম্পের প্রকোপ থেকেই রক্ষা করে না, পাহাড়ের উর্বরা মাটি খাদ্যেরও জোগান দেয়। নানা ধরনের সবজি, ফলমূল, ধানসহ হরেক ফসল পাহাড়ের গায়ে উৎপন্ন হয়। যা নৃ—গোষ্ঠীদের খাদ্যের জোগান দেওয়ার পর বাণিজ্যিকভাবে সমতলে চলে আসে। এ ছাড়াও পাহাড়ি গাছ—গাছালির গুরুত্ব তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে বলতে হয় পাহাড়—পর্বত আমাদের জন্য প্রকৃতির বিশেষ আশীর্বাদ, যা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সবার ওপরেই কমবেশি বর্তায়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।