ঢাকা, রবিবার, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১১ রজব ১৪৪৬

মুক্তমত

বিদেশি বিনিয়োগ সংকটে বাংলাদেশ: সমাধান যেভাবে

শানিল সরদার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫
বিদেশি বিনিয়োগ সংকটে বাংলাদেশ: সমাধান যেভাবে

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যে পরিমাণ প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ হওয়া উচিত তা এখনো অর্জিত হয়নি। এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, কাঁচামাল,  শ্রমের সহজলভ্যতা ও বৃহৎ ভোক্তাবাজার থাকা সত্ত্বেও কেন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা? এর কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, এর পেছনে দেশ ও দেশের মানুষ, দেশের বিদেশি বিনিয়োগ সংকটে বাংলাদেশ : সমাধান যেভাবেসার্বিক ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিচারব্যবস্থা এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দায়ী।

এইসব সার্বিক পরিস্থিতি বিদেশি বিনিয়োগ দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

বিদেশি বিনিয়োগ বলতে এমন একটি অর্থনৈতিক কার্যক্রম বোঝায়, যেখানে একটি দেশ তার অর্থনৈতিক সম্পদ অন্য দেশে বিনিয়োগ করে।

এই বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান, কম্পানি বা ব্যক্তি আয় বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিদেশি বাজারে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠা বা সম্প্রসারণ করে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ভৌত মূলধন গঠন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তিজ্ঞান স্থানান্তর, এবং অর্থনীতিকে বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে সহায়ক। দেশের মূলধন ঘাটতি পূরণে এবং শ্রমের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিদেশি বিনিয়োগ অত্যন্ত কার্যকর।

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের বেশির ভাগই পোশাকশিল্পে কেন্দ্রীভূত। ব্যাংকিং, জ্বালানি খাত এবং খাদ্য উৎপাদনেও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে। তবে বিনিয়োগের অতিরিক্ত নির্ভরতা পোশাকশিল্পের ওপর লক্ষণীয়।

এ দেশের বৈদেশিক বিনিয়োগ হ্রাসের পেছনে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ বিদ্যমান।

এর মধ্যে অন্যতম হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতি, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, উচ্চ সুদের হার, অস্থিতিশীলতা, সীমিত রপ্তানিপণ্যের বৈচিত্র্য, রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি। এসব চ্যালেঞ্জ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে বাধা সৃষ্টি করছে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রভাবিত করছে।

আমাদের দেশের স্বাধীনতার পরপরই প্রথমবারের মতো বিদেশি বিনিয়োগ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহে উত্থান-পতন লক্ষ করা যায়। বিশেষত কভিড-১৯-পরবর্তী সময় এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পার্থক্য দেখা গেছে।

অনুমান করা হয়, ২০২২ থেকে ২০২৩ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় ১৬ শতাংশ কমে গেছে। এর অন্যতম কারণ ছিল নির্বাচন। সাধারণত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা নির্বাচনের আগে ও পরে বিনিয়োগ স্থগিত রাখে। কারণ নির্বাচনকালে অরাজকতার ঝুঁকি থাকে। ২০২২ থেকে ২০২৩ সালে প্রায় ৪৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হ্রাসের পেছনে এই ধরনের নির্বাচনসংক্রান্ত অনিশ্চয়তাই মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর উল্লেখ করেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিবেশ অনুকূলে নয়। এক্সচেঞ্জ রেটের ওপর চাপ, রিজার্ভের ঘাটতি এবং মুদ্রাস্ফীতির অস্বস্তি বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ ক্রমাগত কমিয়ে দিচ্ছে। নির্বাচন সময়কালীন অনিশ্চয়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচনকালে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যায়। এ ছাড়া তিনি আরো উল্লেখ করেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে এবং এর প্রভাব বাংলাদেশেও লক্ষ করা যাচ্ছে। কভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় বিনিয়োগের একটি বড় অংশ সেখানে চলে গেছে।

বাংলাদেশের রিজার্ভ ঘাটতি এবং ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতার অভাব ও দুর্নীতির কারণে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে রপ্তানি খাতে ক্ষতির আশঙ্কাও বিদেশি বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করছে। ভৌগোলিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থান থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর দুর্বলতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহ করছে। দেশের রপ্তানিশিল্প কিছু পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় বৈচিত্র্য বাড়ানো এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি। বিদেশি বিনিয়োগ কমার মূল কারণগুলো হলো রিজার্ভ ঘাটতি, ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্বল অবকাঠামো এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি। রপ্তানি খাতের সীমিত বৈচিত্র্যসহ বৈশ্বিক সুদের হার পরিবর্তনও বিনিয়োগ কমানোয় প্রভাব ফেলছে।

বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান হলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সঠিক নীতি ও কৌশল প্রয়োগ করে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

(দৈনিক কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত)

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।