বাংলাদেশে সম্প্রতি যে যা না বলার তা-ই বলেছেন। আর যে যা না করার তা-ই করেছেন।
কোনো রাষ্ট্রে রাজনৈতিকভাবে যখন জনগণ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যাঁরা জড়িত রয়েছেন কিংবা ক্ষমতার অংশীজনদের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব দেখা দেয়, তখনই শুরু হয় নানা অনৈক্য ও অরাজকতা। অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশ এখন তেমন একটি অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি আত্মঘাতী পরিস্থিতি বলে অনেকে মনে করেন। ক্ষমতার রাজনীতি যারা করেন, ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য তাঁদের অনেক রকম কৌশল থাকতে পারে।
কিন্তু কোনো কৌশলই জাতীয় ঐক্য ও স্বার্থবিরোধী হতে পারে না। এই মুহূর্তে যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তাদের মূল কাজ হচ্ছে জাতীয় স্বার্থে কোনো পক্ষপাতিত্ব না করে নিজেদের সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা। জাতীয় নির্বাচনের জন্য সবাই মিলে একটি উপযুক্ত পরিবেশ বা অবস্থা সৃষ্টি করা।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই হোক আর আগামী বছরের প্রথম কয়েক মাসের মধ্যেই হোক, নির্বাচন নিয়ে যেন কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি না হয়।
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী এই দেশে কথিত সংস্কার নিয়ে যত বিতর্ক হয়েছে, তার চেয়ে প্রকৃত অর্থে কাজ হয়েছে অনেক কম। এর পাশাপাশি সচিবালয় থেকে এনবিআর ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে অনেক বেশি। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার প্রথম থেকে এ ব্যাপারে সজাগ হলে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হতো বলে অনেক মনে করেন না। আরো পরিকল্পিতভাবে এগোলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও কমানো যেত, কিন্তু তা হয়নি। সে কারণেই বাজেট সহায়তার জন্য জাপানের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে গত বছরের তুলনায় ঘাটতি হবে অনেক বেশি। এমন পরিস্থিতিতে না চাইলেও অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কার্যকলাপ জনসমক্ষে চলে আসে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কৌশলগতভাবে অনেক কিছু ধরে রাখতে না পারলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ঐক্যের পথটি আরো প্রশস্ত হওয়া উচিত ছিল। পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং জাতীয় ঐকমত্যের অভাবে সেটিও তেমনভাবে এগোয়নি।
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সমর্থক বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস বৈঠক করেন গত ২৪ জুন। এতে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণভাবে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার আশ্বাস দেয় বলে জানা গেছে। বৈঠকে ড. ইউনূস নির্বাচন, সংস্কার ও বিচারের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন বলে জানা যায়। কিন্তু দেশের বড় দল বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে অনড় থাকে। অন্যদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক দিক বিবেচনা করে অধ্যাপক ইউনূস ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করার কথায় যথারীতি আগের সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করেন। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অনেকে মনে করেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একটি উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা কোনো দুঃসাধ্য কাজ নয়। এটি একটি সাধারণ সমঝোতার ব্যাপার। ৫ আগস্ট সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন না ঘটলে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২০২৯ সালে। তেমন একটি পরিস্থিতিতে বিএনপি কিংবা অন্যান্য বিরোধী দলের আর কী করার ক্ষমতা ছিল? তারা তো তাদের দীর্ঘ দেড় দশকের আন্দোলন-সংগ্রামে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়নি। তাহলে এখন কেন ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অনড় অবস্থান? এ ক্ষেত্রে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অভিমত হচ্ছে, অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি বিএনপির আস্থা কিংবা বিশ্বাসের সংকট দেখা দিয়েছে। তাদের মতে, পক্ষপাতের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত কালো ছায়া নেমে এসেছে নির্দলীয় প্রবীণ ব্যক্তিত্ব ইউনূসের ওপর এবং সে অভিযোগ খণ্ডন করার দায়িত্ব এখন সম্পূর্ণই তাঁর। কারণ তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান।
অধ্যাপক ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক বৈঠকগুলোতে বারবার একটি কথা বলেছেন, ‘আমি যত দিন দায়িত্বে আছি, দেশের কোনো অনিষ্ট হবে না। ’ তিনি আরো বলেছেন, ‘আমরা বর্তমানে এক ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে দেশকে নানা উপায়ে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চলছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের রক্ষা পেতে হবে। বিভাজন কাটিয়ে ঐক্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে হবে। ’ তিনি অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন, ‘ভারত-আওয়ামী লীগ চক্র গত ৯ মাসে অন্তত ২০০টি চক্রান্ত করেছে। কিন্তু সংগ্রামী ছাত্র-জনতা, সেনাবাহিনী ও অন্তর্বর্তী সরকারের সুদৃঢ় ঐক্যের কারণেই সেসব চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে। তার পরও চক্রান্তকারীরা তৎপর রয়েছে। তারা আমাদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণও চালাতে পারে। দেশকে অস্থিতিশীল করে এ দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীও পাঠাতে পারে। ’ অধ্যাপক ইউনূসের উপরোল্লিখিত গুরুতর অভিযোগের কথাগুলো এরই মধ্যে দেশের মানুষ শুনেছে এবং তারা দেশের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কি আমাদের দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর কিছুই করার নেই? অন্তর্বর্তী সরকার থেকে অধ্যাপক ইউনূস কখনো যদি অভিমানবশত সরেও যান, তাতে কি আওয়ামী-ভারতীয় ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটবে? সে অবস্থায় কোনো দল বা ব্যক্তি যদি সেই অপশক্তির সঙ্গে আপস করতে যায়, তাহলে কি ন্যূনতম সময়ের জন্যও তাদের পক্ষে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা সম্ভব হবে? তাই এখানে মূল বিষয়টি ডিসেম্বর কিংবা জুনের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে নয়, আশঙ্কা রয়েছে দেশের সার্বিক নিরাপত্তার প্রশ্নে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে।
উপরোল্লিখিত ভীতিজনক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, অতীতে মহাজোট করে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে একটি তাঁবেদারি রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। দেশ পরিণত হয়েছিল বিদেশি শক্তির মদদে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে। এর বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলন ও কর্মসূচি আজ একটি গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। ফ্যাসিস্টরা তাদের ক্ষমতা দখলে মরণ কামড় দিতে প্রস্তুত হচ্ছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে দেশ এখন দৃশ্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলে তাঁর ধারণা। একদিকে গণতন্ত্র ও মুক্তিকামী মানুষ, অন্যদিকে ফ্যাসিবাদীদের দোসর অপশক্তি। এই অবস্থায় বাংলাদেশ যাবে কোন পথে? তিনি বলেছেন, সে ফয়সালা হবে রাজপথে।
অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বিভিন্ন উপলব্ধির মধ্যে সম্প্রতি হঠাৎ করে একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব প্রকাশ্যে এসেছে সবাইকে অবাক করে। গত সপ্তাহে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সমাবেশে একটি নাগরিক গোষ্ঠী বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো অবস্থায়ই স্বস্তিতে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। বিভিন্ন ষড়যন্ত্র কিংবা চক্রান্তের মুখে তারা বারবার হোঁচট খেয়েছে। সুতরাং উপরোল্লিখিত নাগরিক গোষ্ঠীটির মতে, দেশপ্রেমিক বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা অত্যন্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এতে তারা প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারের প্রধান (রাষ্ট্রপতি) হিসেবে অধ্যাপক ড. ইউনূস, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান ডা. শফিকুর রহমানের নাম প্রস্তাব করেছে। তারা আরো বলেছে, প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারে বিএনপি ২৫ শতাংশ, জামায়াত ২০ শতাংশ, এনসিপি ১ শতাংশ, ইসলামী আন্দোলন ৫ শতাংশ, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ১০ শতাংশ এবং বাকি দলগুলো ২৫ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব পাবে। এ ধরনের প্রস্তাব কতটুকু বাস্তবসম্মত, তা জানা না গেলেও এতটুকু বোঝা গেছে যে দেশপ্রেমিক শক্তির সমন্বয়েই সেই জাতীয় সরকারের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে।
দেশের রাজনীতিসচেতন মানুষ মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং মতবিরোধ এড়িয়ে অধ্যাপক ইউনূস, বিএনপি নেতা তারেক রহমান, জামায়াত নেতা ডা. শফিকুর রহমান, এনসিপির তরুণ নেতা নাহিদ ইসলামসহ অন্যদের দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ বা অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। নতুবা জুলাই-আগস্টের সব আত্মত্যাগ বিফলে যাবে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র মতবিরোধগুলো কাটিয়ে জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরে হবে, না ডিসেম্বর থেকে আগামী জুনের মধ্যে হবে, তার একটি চূড়ান্ত ফয়সালা করে ফেলা জরুরি। সামনে আমাদের হাতে যে সময় অবশিষ্ট রয়েছে, তা অতি দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। অথচ তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা বাড়ছে অকল্পনীয়ভাবে। আমাদের সামনে আজ এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা উপস্থিত হয়েছে। এটি সম্মিলিতভাবে এবং সাফল্যজনকভাবে অতিক্রম করার মধ্যেই আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি নিহিত রয়েছে। আমরা এখন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
[email protected]