ঢাকা, রবিবার, ৯ আষাঢ় ১৪৩২, ২২ জুন ২০২৫, ২৫ জিলহজ ১৪৪৬

মুক্তমত

বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন আবশ্যক

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৩৭, জুন ২১, ২০২৫
বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন আবশ্যক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

গল্পগুলো মোটেই নতুন নয়; সবগুলোই জানা এবং শোনা। ঘুরেফিরে তাদের কথাই শুনতে হয়; লোকমুখে, পত্রপত্রিকায়।

দৈনিক পত্রিকাগুলোর কারবার তো গল্প নিয়েই। দুরকমের গল্প পাঠক বেশ পছন্দ করে। রাজনীতির এবং অপরাধের। রাজনীতি এখন জটিল-মিশ্র ডামাডোলের মধ্যে রয়েছে। ও নিয়ে আলোচনা এ মুহূর্তে থাক। অপরাধের খবর বেশ পাওয়া যায়। অপরাধগুলোও যে খুব বৈচিত্র্যপূর্ণ তা অবশ্য নয়। মোটামুটি একই রকমের। ব্যতিক্রমী দু-একটি ছাড়া অপরাধের পেছনে যে অপরাধ থাকে তাদের সম্পর্কে তদন্ত করবে এমন সাধ্য নেই পত্রিকার। সাংবাদিকরা পারেন; তাদের সেই সক্ষমতা রয়েছে, তবে তাদের তদন্ত করতে দেওয়া হয় না।  

দেশে সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে সম্পদ পাচার। সম্পদ তৈরি হয় মানুষের শ্রমে, আর সম্পদ যারা তৈরি করেন তারা বঞ্চিত হবেন, এটাই অবশ্য নিয়ম। সে নিয়মই চলে আসছে যুগ-যুগান্তর ধরে। সম্পদ পাচারকারীদের কার্যক্রম এবং পরিচয় দুটোই রোমহর্ষক পর্যায়ের; কিন্তু সেটা উন্মোচিত হয় না। আরেক অপরাধ খেলাপি ঋণ। ব্যাংক নিজে টাকা তৈরি করে না, ব্যাংকে টাকা জমা রাখে দেশের মানুষ; সেই টাকা ব্যাংকের সাহায্যেই নিয়ে নেন বড় বড় ধনীরা। টাকাটা যদি তারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতেন তবু না হয় বুঝতাম কাজে লাগছে। না, ওই টাকা কাজে লাগে না; তার বড় অংশই বাইরে চলে যায় অদৃশ্য পথে।

ওদিকে সংবাদপত্রগুলোও যে খুব সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে, তা মোটেই নয়। সংখ্যায় খবরের কাগজ এখন অনেক; কিন্তু তাদের অধিকাংশই পাঠককে আকর্ষণ করে না। প্রধান কারণ, যে গল্পগুলো তারা ছাপে সেগুলো সবই ভাসাভাসা, সত্যের গভীরে যায় না। অনেক ক্ষেত্রে বরং সত্য চেপে যায়। এবং খবরগুলো সবই একই ধরনের। পূর্বপরিচিত। ওদিকে আবার পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে তথাকথিত সামাজিক মাধ্যম। যেখানে আঙুল দিয়ে টিপলেই খবরের কাগজে যে খবর পরে ছাপা হবে, তা চলে আসে। তা ছাড়া  সেখানে থাকে গুজব; অনেক গুজব এমন যা সংবাদপত্রের সাধ্য নেই ছাপে। এবং লোকে মনে করে যা রটে তা কিছু কিছু তো বটে। সামাজিক মাধ্যমে আবার নানা রকমের মন্তব্যও পাওয়া যায়-যেগুলো কেবল যে মুখরোচক তা-ই নয়, প্রায়শই ক্ষুব্ধ মনের প্রতিক্রিয়া-যে ক্ষোভ সংবাদপত্রে প্রকাশের পথ পায় না। তা ছাড়া খবরের কাগজ তো মাঝেমধ্যে বন্ধও থাকে।

বৈচিত্র্যপূর্ণ গল্পের আকালটা নাটক এবং চলচ্চিত্রকেও আক্রমণ করেছে। স্বাধীনতার পর ঢাকায় গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল নাটকের ক্ষেত্রে নবসৃষ্টির একটা জোয়ার বয়ে যাবে। সেটা ঘটল না। বড় কারণ ভালো নাটকের অভাব। ভালো নাটক তো পরের কথা, যেনতেন প্রকারের নাটক লেখাও কমে গেল। নাট্যকাররা কী নিয়ে লিখবেন? গল্প পান না। যেসব গল্প চারদিকে দেখেন তাদের নিয়ে নাটক জমে না। গল্পের ভিতরেও অবশ্য গল্প থাকে, গল্পে জড়িত মানুষদের অনুভূতি অনুভব অভিজ্ঞতা নিয়েই তো গল্প; সেসবের খোঁজ করার জন্য প্রয়োজন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির। এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিটা কোনো মানুষের একার সম্পত্তি নয়, সেটা গড়ে ওঠার জন্য পরিবেশ ও পরিস্থিতির আনুকূল্য চাই। আনুকূল্য নেই। সেজন্য গল্পের ওপরটাই দেখা যায়, আদত খবর পাওয়া যায় না। তদুপরি নাটকের সামাজিক মঞ্চায়ন তো এখন খুবই কমে গেছে।  

আগের দিনে পাড়া-মহল্লায় নাটক হতো, এখন হয় না। অনেক জায়গায় কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে, সেখানে নাটক মঞ্চায়ন সম্ভব, যদি উদ্যোগ থাকে; কিন্তু উদ্যোগ নেই। প্রধান কারণ মানুষ এখন আগের তুলনায় অনেক অধিক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সামাজিকভাবে যে কাজ করবে সে উৎসাহে ভাটা পড়েছে। দায়ী অবশ্য পুঁজিবাদের উৎপাত। পুঁজিবাদ মানুষকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে, সমবেত হতে দেয় না। প্রত্যেকেই নিজের নিজের মুনাফা খুঁজে, ফলে তারাই শুধু সুবিধা করে নেয়, যারা অন্যদের ঠকাতে পারে। ‘দশে মিলে করি কাজ, হারিজিতি নাহি লাজ’, এ মনোভাব আগের কালে তবু বইতে পাওয়া যেত, সমাজে যদিও কমই ছিল, কিন্তু এখন তো তা পরিপূর্ণরূপেই অনুপস্থিত। এমনকি বইপুস্তকেও নেই। ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’, এ নীতিবাক্য এখন হাস্যকর শোনায়, কারণ বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত।

নাটক দেখার একটা সুযোগ ছিল টেলিভিশনে। টেলিভিশনে নাটক এখনো দেখানো হয়, চ্যানেল অনেক, তাই নাটকও অনেক। কিন্তু সেই একই সমস্যা, নাটকে গল্প নেই। নাটকের গল্পে প্রধান প্রয়োজন দ্বন্দ্ব। যে কোনো গল্পেই আসলে দ্বন্দ্ব থাকে। দ্বন্দ্ব এখন জীবনের সর্বত্র; কিন্তু সেসব দ্বন্দ্বের মূলে যে কারণ অর্থনীতি ও রাজনীতি, তাদের বিবেচনার বাইরে রেখে দেওয়া হয়; ফলে আসল গল্পটা সামনে আসে না, এবং গল্প জমে না। টাকাপয়সার কথা, প্রতারণা-ছলনা, সংঘাত-সংঘর্ষ, এসবই থাকে নাটকজুড়ে। তাদের পেছনকার কারণ হয়তো মুচকি হাসে। তা ছাড়া টেলিভিশন তো আসলে চলে বিজ্ঞাপনের জোরে। তাই দেখা যায় বিজ্ঞাপন আচমকা ঢুকে পড়ছে নাটকের ভিতরে; কখনো কখনো মনে হয় নাটক দেখানো বুঝিবা বিজ্ঞাপন প্রচারের অজুহাত মাত্র। চলচ্চিত্রের যে দুর্দশা এখন দেখা দিয়েছে তারও একটা কারণ কিন্তু গল্পের দুর্বলতা। গল্পের অভাবকে ভরার চেষ্টা করা হয় ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি, গুন্ডামি, চিৎকার, কান্নাকাটি ইত্যাদির হট্টগোল দিয়ে।

২.

আমাদের দেশের গত সাধারণ নির্বাচনে তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। সরকারবিরোধী বলে পরিচিত কোনো দলই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলতে যা ঘটেছে তা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘স্বতন্ত্র’দের। স্বতন্ত্ররাও আওয়ামী লীগেরই লোক। আগের কালে এদের বলা হতো ‘বিদ্রোহী’; তখন বলা হয়েছে স্বতন্ত্র, এবং পরোক্ষে অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে তাদের ওই স্বাতন্ত্র্যকে। মাত্র একজন প্রার্থী যদি থাকে তবে তো ভোটাররা আসবে না; ভোটারদের আনা দরকার। ফাঁকা গোলকে তো গোল বলা যাবে না, এমনকি পেনাল্টি শটে জেতার জন্যও তো একটা বন্দোবস্ত প্রয়োজন, তাই না? নির্বাচনে একের অধিক প্রার্থী তাই অত্যাবশ্যক। ভোটারদের সুযোগ দেওয়া চাই বাছবিচারের। ভোটাররা অবশ্য পাঁচ বছর পার করে প্রাপ্ত তাদের ওই সুযোগ প্রয়োগ করতে তেমন একটা উৎসাহ দেখায়নি।

এ রকমের ‘নির্বাচনে’ই নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন নাটোরের অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ। প্রকাশ্যেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে নির্বাচিত হওয়ার জন্য তাকে খরচ করতে হয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এ টাকা তিনি তুলে নেবেন। দরকার হলে অনিয়ম করে। অনিয়ম করেই যে তুলতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিয়মমাফিক পথে উদ্ধার করা তো আকাশকুসুম কল্পনাবিলাস। আর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর ব্যবস্থাপনায় নিহত তিন তিনবার নির্বাচিত ঝিনাইদহের যে এমপি আনোয়ারুল আজীম অমন অগাধ অর্থের মালিক হয়েছিলেন, সেটাও নিশ্চয়ই বৈধ পথে ঘটেনি। শোনা গেছে, ঘটেছে স্বর্ণ চোরাচালান ও মাদক ব্যবসার মধ্য দিয়ে। যে কাজে তিনি তার পদকে ব্যবহারে কোনো প্রকার কার্পণ্যই করেননি।

পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তার প্রতিষ্ঠাতা, এবং সে সময়কার ‘জাতির পিতা’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে নতুন রাষ্ট্রের নাগরিকদের এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি যেন প্রশ্রয় না পায়। বলেছিলেন, প্রশ্রয় পেলে তারা কিন্তু মারাত্মক রকমের ক্ষতির কারণ হবে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রে ওই দুই জিনিসই ছিল সর্বাধিক তৎপর। বাংলাদেশ রাষ্ট্র আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং ওই রাষ্ট্রকে ভেঙে ফেলে। কিন্তু দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি তো অক্ষতই রয়ে গেছে। কমবে কই, বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্নীতি ছাড়া উন্নতি নেই। আর স্বজনপ্রীতি যে কেমন দুর্ধর্ষ হতে পারে তার প্রকাশ্য ও ব্যাপক প্রমাণ তো আমরা হরহামেশা পাচ্ছি। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যমান সাবেকী ব্যবস্থার পরিবর্তনে দেশপ্রেমিকদের সংগঠিত হওয়ার বিকল্প নেই। জাতীয় ঐক্য ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এনজি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।