ইংরেজদের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ তিতুমীর বা সৈয়দ মীর নিসার আলীকে চিনেছি সেই ছোটবেলায়; পাঠ্যবইয়ে তার সম্পর্কে পড়ে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নাম স্মরণে এলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়।
আমাদের এ ভূখণ্ডকে আলোকিত করেছেন আরও অনেকে। দেশের সব শ্রেণির মানুষ যাদের শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন, এরকম মানুষের তালিকায় আছেন—নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবীর এম এ জি ওসমানী, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, মেজর এম এ জলিল, আ স ম আব্দুর রব, এফ আর খান, ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম, নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী, অমর্ত্য সেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন, এস এম সুলতান, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ, আব্বাস উদ্দিন আহমদ, কায়কোবাদ, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, জহির রায়হান, সৈয়দ আলী আহসান, ড. কাজী দীন মুহাম্মদ, হাজী মুহাম্মদ মহসিন, মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ, হযরত খান জাহান আলী (রহ.), কামরুল হাসান, সাপ্তাহিক হলিডে ও নিউ এজ সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, ব্রজেন দাস, ড. শমসের আলী, স্টিফেন হকিংয়ের বন্ধু বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম, হযরত শাহ জালাল (রহ.), প্রখ্যাত মনীষী হযরত মুহাম্মদ আলী শাহ, মৌলভী আবুল কাসেম (রহ.), সানাউল্লাহ নূরীসহ আরও অগণিত ব্যক্তিত্ব।
যাদের নাম উল্লেখ করলাম তারা সর্বজন শ্রদ্ধেয়। কেউ কেউ হয়তো কারো কারো বিষয়ে কিঞ্চিৎ সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু সে সমালোচকের সংখ্যা হবে হাতেগোনা। আমরা বইপুস্তকে তাদের সম্পর্কে পড়েছি, জেনেছি।
এ তালিকায় আরও একজনের নাম আসতে পারতো। আসাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আনা যায়নি। কারণ তিনি ‘দেবতা’! মানুষের তালিকায় কোনো দেবতার নাম আনা যুক্তিসঙ্গত নয়। আর সেই দেবতার নাম পাঠ্যবইয়ে আনতে গিয়ে যেসব শ্রদ্ধেয় মানুষের নাম উল্লেখ করলাম তাদের প্রায় কারো নাম দীর্ঘদিন আমরা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইয়ে পাইনি পতিত স্বৈরাচারের আমলে।
সেই দেবতা রাজত্বকালে তার অধীন মানুষকে সোজা করতে যা যা করা দরকার বলে তিনি মনে করেছেন, তার সবকিছু করেছেন। যুদ্ধে সাহায্য করেছে—এই অজুহাতে ভারতকে দেশের সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তারা হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ দেশ থেকে লুট করেছে, তাতে সহযোগিতা করেছেন। মেজর জলিল তাতে বাধ সাধায় তাকে জেলে যেতে হয়েছে। হাজার হাজার প্রগতিশীল যুবক নিহত হয়েছেন। প্রতিবাদী সিরাজ শিকদারকে হত্যা করে দম্ভ করে বলা হয়, ‘লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে দিছি’।
দেবতা তো দেবতা! তাকে নিয়ে আবার সংবাদপত্র কেন লিখবে? তাই ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সরকার-সমর্থক ৪টি বাদে দেশের সবগুলো সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে একই সালের ২৫ জানুয়ারি মাত্র ১৫ মিনিটে জাতীয় সংসদে বিল পাস করে বাকশাল গঠন করা হয়। নিষিদ্ধ হয় সমস্ত রাজনীতি। মানুষ তার কথা বলাসহ গণতান্ত্রিক সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। বাকরুদ্ধ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আসে ১৫ আগস্ট। এরপর বেশ কিছুদিন মানুষ মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নেয়।
আমার আলোচনার বিষয়—‘দেবতা’। তাই অন্যান্য রাজনৈতিক বিষয় আনছি না। এই দেবতা শুধু স্বপ্ন দেখতেন—লাল স্বপ্ন, নীল স্বপ্ন, হলুদ স্বপ্নসহ আরও অনেক স্বপ্ন। তবে তিনি ঘুমিয়ে না জেগে দেখতেন, সে বিষয় দেবতার পূজারিরা স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেবতা কী কী স্বপ্ন দেখতেন তা স্পষ্ট হয়। দেবতার আরাধনার জন্যে দেশের আনাচে-কানাচে তার মূর্তি নির্মাণ করা হয়। ঘরে ঘরে টাঙানো হয় তার ছবি। বইয়ের পাতায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে চলে আসে ‘দেবতা বন্দনা’। ছোট ছোট শিশুদের দেবতার ভাষণ মুখস্থ করানো হয়। দেবতা পূজায় তৈরি করা হয় নানা দিবস। দেবালয় থেকে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয় পূজা যেন যথাযথভাবে উদযাপন করা হয়। আর দেবতাকে সুরক্ষা দিতে দেবালয় থেকে করা হয় নানা আইন।
দেবতা ও দেবালয় নিয়ে কেউ যেন কিছু না বলতে পারে, সে জন্য প্রথমে করা হয় ৫৭ ধারা। এরপর ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ নানা আইন। এ আইন ঠিকঠাক পালিত হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্যে করা হয় অন্যান্য জরুরি সেবার মতো ২৪ ঘণ্টার মনিটরিং সেল। দেবতা ও তার পূজারিদের সুরক্ষা বিঘ্নিত হওয়ায় কত মানুষকে যে আয়নাঘরে যেতে হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। খুন-গুম হয়েছে অসংখ্য মানুষ।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর সেই দেবতার আরাধনা কমে যায় বলে মনে করা হয়। কিন্তু জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সেই দেবতাকে ফের প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে বলে দৈনিক আমার দেশ সম্প্রতি একটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে— প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ এবং মাধ্যমিকের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ে ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আছে বিস্তারিত বর্ণনা।
শুধু তাই নয়, অযৌক্তিকভাবে অষ্টম শ্রেণির বাংলা বই ‘সাহিত্য-কণিকা’য় বহাল ভাষণটি রাখার চেষ্টা হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, “বাংলা সাহিত্যে ভাষণটি রাখার প্রাসঙ্গিকতা না থাকলেও পাঠ্যপুস্তকে মুজিবীকরণের আগের সে প্রক্রিয়া এখনো বহাল থাকছে। ”
অন্তর্বর্তী সরকারের একটি প্রভাবশালী মহল পাঠ্যপুস্তকে মুজিবীকরণের পূর্বতন ধারা বহাল রাখার চেষ্টা করছে বলেও আমার দেশ’র ওই প্রতিবেদনে বলা হয়ছে। যে ‘দেবতা’কে ঘিরে দেশের অসংখ্য মানুষ খুন, গুম, আয়নাঘরে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, নতুন বাংলাদেশে সেই দেবতাকে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অনাকাঙ্ক্ষিত।
সাইফুর রহমান সাইফ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোর