আমাদের প্রত্যাশা ছিল মানুষ শুধু স্বাধীনতা পাবে না, মুক্তিও পাবে। কেননা মুক্তিযুদ্ধটা ছিল সর্বাত্মক জনযুদ্ধ এবং এটার লক্ষ্য ছিল সর্বাধিক মুক্তি অর্জনের।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছিল। সেই রাষ্ট্রে প্রধানত যেটা থাকবে, সেটা হলো অধিকার এবং সুযোগের সমতা। এই সাম্য আমাদের আগের রাষ্ট্রে ছিল না। আর অর্থনৈতিক মুক্তি, যেটা মুক্তির প্রাথমিক শর্ত, সেটা কিন্তু এই আকাক্সক্ষার মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হলো। দেশ কেবল রাষ্ট্রীয়ভাবে, রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হবে তা নয়, রাষ্ট্র মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত করবে এবং সুযোগ ও অধিকার অবারিত হবে, এটাই ছিল স্বপ্ন।
এই রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করতে হলে প্রধান উপাদান হবে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এগুলোর ভিত্তিতেই নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। ধর্মনিপেক্ষতার বিষয়টিও স্পষ্ট করা দরকার। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে এটা নয় যে কেবল সব ধর্মের সমান অধিকার থাকবে এবং সব ধর্মের চর্চা বাড়বে। ধর্মনিরপেক্ষতার মূল বিষয় হলো, রাষ্ট্র এবং ধর্ম পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। অর্থাৎ ধর্ম হবে ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের ব্যাপার।
রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না। এই যে মৌলিক ব্যাপার, সেটা খুব জরুরি ছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কখনই এককেন্দ্রিক হবে না। রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে। জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র ছিল আমলাতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার একটা প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার জায়গায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আসবে। অর্থাৎ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে এবং জনপ্রতিনিধিরা এই রাষ্ট্রের কর্তা হবে। আমলাতন্ত্র জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। এ ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সেজন্যই আমাদের সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথাটা এসেছিল। এটা ওপর থেকে কেউ চাপিয়ে দেয়নি। এটা মুক্তির আকাক্সক্ষার ভিতর থেকেই এসেছিল।
সেটা একেবারেই যে পূর্ণ হয়নি, তা নয়। ভৌগোলিকভাবে আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র, সংবিধান, রাষ্ট্রভাষা পেলাম, পরিচয় পেলাম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে। পাকিস্তান একটা অস্বাভাবিক রাষ্ট্র ছিল। ওই রাষ্ট্র ভাঙতই। এবং সেটা কেবল ভৌগোলিক দূরত্বের কারণেই নয়, ভাঙত বৈষম্যের কারণে। ভৌগোলিক দূরত্ব ওই বৈষম্যকেই বৃদ্ধি করেছিল। আশা ছিল বাংলাদেশে আঞ্চলিক বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু আঞ্চলিক বৈষম্যের জায়গায় আমরা বাংলাদেশে পেলাম শ্রেণিগত বৈষম্য। শ্রেণিগত বৈষম্যটা ক্রমাগত বেড়েছে। অধিকার ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠিত না করে রাষ্ট্র উল্টো দিকে গেছে। ক্রমাগত বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
একাত্তরে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে স্বাধীনতার পরপরই। সংঘর্ষপ্রবণ হয়েছে মানুষ। প্রত্যেকটা মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থ দেখছে। অল্প কিছু লোক ধনী হয়ে গেল। পাকিস্তান আমলে অবাঙালিরা ধনী হতো, পরে বাঙালিরা ধনী হয়েছে। ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। সেটা হলো কর্মের সংস্থান হয়নি। যারা ধনী হলো, তারা প্রায় সবাই হঠাৎ করে ধনী হয়েছে। অবৈধ উপায়ে ধনী হয়েছে। ব্যবসাবাণিজ্যের মাধ্যমে কেউ ধনী হয়েছে। কেউ হয়েছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপি হয়ে। অনেকে ধনী হয়েছে বিদেশি কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে। এসব বড়লোকের অধিকাংশেরই দেশপ্রেম নেই। তারা ধারণা করছে বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই তারা তাদের ভবিষ্যৎ এই দেশে দেখতে পাচ্ছে না। তাদের সন্তানরা বাইরে লেখাপড়া করছে। তারা সম্পত্তি বাইরে পাচার করছে। নির্বাচিত সরকার আসে, সামরিক সরকার আসে, এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারও। কিন্তু ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং আরও ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, সরকার কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগও হচ্ছে না। যেসব কলকারখানা সচল ছিল চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়েছে অগণিত কলকারখানা। আগুনে পুড়েছে, ভাঙচুর হয়েছে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মালিকরা কেউ জেলে আর অনেকে দেশান্তরী হয়েছে। অরাজকতা, সন্ত্রাসের ব্যাপকতা সৃষ্টি হয়েছে। মব সন্ত্রাস তো এখন ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগীদের কারণে লুণ্ঠন-সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত। সুবিচার নেই, কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই। মানুষ তাই নির্ভরশীল হচ্ছে আধিদৈবিক শক্তির ওপরে। মনে করছে, পরকালে সে শাস্তি পাবে। অথচ আমরা ভেবেছিলাম এই রাষ্ট্র সত্যিকার অর্থেই জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। কিন্তু রাষ্ট্রে সেটা নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটেনি।
জাতীয় ঐক্যের কথা সরকার বলছে, কিন্তু ঐক্যের কথা বলতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে কার বিরুদ্ধে ঐক্য এবং কীসের জন্য ঐক্য। কার বিরুদ্ধে ঐক্য সেটা একাত্তরে আমরা জানতাম, ঐক্য ছিল পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার জন্য ঐক্য। এখন ওই ঐক্য নেই। মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ, সে আদর্শ সামনে আনতে হবে। সে আদর্শটা ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ওই আদর্শে যারা বিশ্বাস করে, তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই ঐক্যটা শুধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলে আসবে না। একাত্তরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হওয়ার নিরিখ নয়। নিরিখটা হচ্ছে, আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষক-দোসরদের বিরুদ্ধে ঐক্য এখন অতীব জরুরি। কেননা সাম্রাজ্যবাদের চোখ পড়েছে আমাদের ভূমি, বন্দর ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর।
জামায়াতের নায়েবে আমির বলেছেন, জুলাই আন্দোলনের রূপকার তাঁদের দল। তবে ছদ্মবেশে জুলাই আন্দোলনের নেপথ্যে থেকেছে। স্বাধীন বাংলা বেতারের গান, রবীন্দ্র, নজরুল, ডিএল রায়ের গানে উজ্জীবিত করতে পেরেছে আমজনতাকে। স্বৈরাচারী সরকারের পতনে জামায়াত যে ভরকেন্দ্রে ছিল এটা আন্দোলনে অংশ নেওয়া অগণিত মানুষের ধারণাতেই আসেনি।
দেশে মৌলবাদের বিকাশের ক্ষেত্রটা নষ্ট হলো না। সেটা ব্যাপক আকারে সামনে চলে এসেছে, এটাও অসত্য নয়। দরিদ্র মানুষ মুক্তির কোনো পথ পাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে যারা নিজেদের মনে করেন, তাদের আচরণ আদর্শ আচরণ নয়। ব্যক্তিগত স্বার্থকে তারাও বড় করে দেখছেন। কাজেই মানুষের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশের পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। যার ফলে মানুষ মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এটা আন্তর্জাতিকভাবেও সত্য।
আজকের যুগে সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া। আমাদের দেশের সরকারি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তো খোলাখুলি আলোচনাই হতে পারে না। কিন্তু বিদেশি ইলেকট্রনিক মিডিয়া যে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির সংবাদ দিচ্ছে, তাতে তো সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এই সংবাদ আমরাও পাচ্ছি, বিদেশিরাও পাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই যুগে ভাবমূর্তির ব্যাপারে অতিরিক্ত স্পর্শকাতর হলে ভাবমূর্তি আরও নষ্ট হয়। তখন মনে হয়, অনেক কিছু লুকানোর আছে, যা প্রকাশ করা যাবে না। ভাবমূর্তি নির্ভর করবে আমরা কী করছি তার ওপর। সমষ্টিগতভাবে আমরা কী করছি সেটাই বিবেচ্য। মব ভায়োলেন্সের নৃশংস সব ঘটনা আমরা যেমন দেখছি, তেমনি সারা বিশ্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি তলানিতে ঠেকছে।
প্রত্যাশা হচ্ছে, সমাজ গড়তে মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ তা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন অব্যাহত রাখা। এ আদর্শ বাস্তবায়িত হলে মানুষ ওই চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হবে। এই ঐক্য তখন একটা নতুন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে পুষ্ট করবে।
অতীতকে ভোলার তো প্রশ্নই ওঠে না। অতীত ভুলতে পারে উন্মাদ বা বিকৃতমনের মানুষ। স্মৃতিভ্রংশ মানুষ যেমন স্বাভাবিক মানুষ নয়, স্মৃতিভ্রংশ জাতিও তেমন স্বাভাবিক জাতি নয়। চাইলেই কি আমরা অতীতকে ভুলে যেতে পারব? অতীত তো আমাদের বর্তমানের মধ্যে প্রবহমাণ রয়েছে। সে কারণে অতীতকে ভোলার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের দুটি কাজ করতে হবে। অতীতে যে ভালো কাজগুলো ছিল, সেগুলোকে বিকশিত করতে হবে। অতীতে যে গণতান্ত্রিক উপাদান, ঐক্য, যে সংগ্রামী চেতনা ছিল তার বিকাশ চাই। আর যে খারাপ দিকগুলো যেমন, সংকীর্ণতা, পশ্চাৎপদতা, সেগুলোকে পরিহার করতে হবে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়