ঢাকা, রবিবার, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

যেখানে মিটার সেখানেই ‘চিটার’ !

পলাশ মাহবুব, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৪
যেখানে মিটার সেখানেই  ‘চিটার’ !

যেখানে মিটার সেখানেই ‘চিটার’।

একটু আগে থেকে শুরু করা যাক।

যারা বিদ্যুৎ-বিল দেন বিষয়টি তাদের মনে থাকবার কথা। বিদ্যুৎ বিলের মিটার রিডারদের ভোলেন নি নিশ্চয়ই। এদের কোটিপতি হবার গল্প পত্রিকার পাতায় হাজারবার এসেছে। বিদ্যুৎ অফিসের মিটার রিডার অথচ ঢাকা শহরে দু-তিনটে করে বাড়ি, বিঘায় বিঘায় জমি। পাজেরো গাড়িতে স্কুলে যায় ছেলে-মেয়েরা। বউ শপিং করতে যায় ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর।

আঙুল ফুলে কলা গাছ হতে দেখেছেন। কিন্তু বটগাছ হতে কি দেখেছেন! বিদ্যুৎ অফিসের মিটার রিডাররা একেকজন তাই হয়েছে। ভৌতিক বিল কিংবা কারসাজি করে একেকজন মিটার রিডার রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। বারোটা বেজেছে দেশের, দশের।

এখন অবশ্য সে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের মিটার রিডারদের দৌরাত্ম্য কিছুটা হলেও কমেছে। নতুন করে তাদের বাড়ি-গাড়ির খবর খুব একটা পত্রিকায় আসছে না। হতে পারে বিষয়টির সঙ্গে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিংবা ধরেই নিয়েছি বিদ্যুতের মিটার রিডাররা জালিয়াতি করবেই। তারা বনসাই থেকে মহীরুহ হবেই।

অথবা এমনটাও ধরে নিতে পারি, মিটার রিডারদের শ্বশুরকুলের ধন-সম্পত্তিতে টান পড়েছে। কারণ তাদের ভাষ্যমতে, ধন-সম্পদের মালিক তো তারা না, সবই শ্বশুরকুল থেকে পাওয়া। ভাবতে ভালোই লাগে, ধনী লোকের জামাই হিসেবে মিটার রিডারদের দিন ছিল বটে।

বিদ্যুতের মিটার রিডারদের দিন ফুরিয়েছে তো কি হয়েছে? মিটার তো শুধু বিদ্যুতের বেলাতেই লাগে না। মিটার প্রয়োজন আরও অনেক ক্ষেত্রে। সোজা করে বললে সব ক্ষেত্রেই। তিতাস গ্যাসের মিটার রিডাররা তো ফুলতে ফুলতে ঢোল হয়েছেন অনেক আগেই। অবশ্য তাদের জন্যও দুঃসংবাদ আছে। দেশে গ্যাসের মজুদ কমতে শুরু করেছে। গ্যাস না থাকলে আমাদের অনেক সমস্যা হবে, কিন্তু তাদের কি হবে!

মিটার নিয়ে সর্বশেষ উৎপাতের নাম সিএনজিচালিত অটো রিক্সা। সবুজ রঙের এই বাহনটিকে সবাই চেনেন। সিএনজিতে চড়া আর হাতিতে চড়া সমান পর্যায়ে চলে গেছে। যদিও সিএনজি চালিত এই বাহনটিতেও একটি মিটার আছে। কিন্তু কথা তো ওইখানে- যেখানে মিটার, সেখানেই ‘চিটার’ (আসলে মূল ইংরেজি শব্দটা হবে ‘চিট’। তবে মুখে মুখে ‘চিটার’-টাই মানুষ বলে বেশি)। সিএনজির ওই মিটারটি অবসরে চলে গেছে বহু আগে। এখন মিটার শুধু বাহনটির শোভাবর্ধন করে কিংবা ঝামেলা তৈরি করে। কোনও কাজে লাগে না। মানে কাজে লাগানো হয় না।

বেশি কথা বললে বলবে, মিটার নষ্ট।
ঠিক করছো না কেন?
মালিকরে জিগান।
চালাচ্ছ তুমি, মালিককে জিজ্ঞেস করব কেন?
কন্টাকে গেলে চলেন নইলে আলাপ বন্ করেন...
ব্যবহারে বংশের পরিচয় হলে সিএনজিচালকরা কোন বংশের লোক তা নিয়ে গবেষণায় নামতে হবে। মাঝেমাঝে মনে হয়, এই শহের সিএনজিচালক হতে পারলেও কাজের কাজ হতো। নিজের ইচ্ছে মতো চলা যেত। সিএনজিচালকরা কাউকে দু পয়সা দাম দিয়ে চলে না। তারা চলে তাদের মতো। তারা মুখ দিয়ে একবার যে ভাড়া বলবে আপনাকে হাসি মুখে সেটাই মেনে নিতে হবে। এবং এমন একটা ভাব করতে হবে সিএনজিওয়ালা আপনার বিরাট উপকার করছেন। উপকারের ঋণ কিভাবে শোধ করবেন সে লজ্জায় আপনি মরে যাচ্ছেন।
ফার্মগেট থেকে বাংলামটর আসার জন্য যদি তারা একশ টাকাও চায়, সে ক্ষেত্রেও বিষয়টি সমানভাবে প্রযোজ্য। একদাম এক রেট। বেশি কথা তাদের পছন্দ না।

আরও কথা আছে। আপনি কোথায় যাবেন সেটা বিষয় না। সিএনজিওয়ালা কোথায় যাবে সেটা হচ্ছে আসল কথা। তাদের যেখানে যেতে ইচ্ছে করবে তারা যাবে। যেখানে যেতে ইচ্ছে করবে না, যাবে না। এ নিয়ে কোনও ধরনের প্রশ্ন কিংবা আপত্তি করা চলবে না।

আপত্তি করবেন?
লাভ নেই। একেরপর এক সিএনজি চলে যাবে সামনে দিয়ে, আপনি ঠায় রোদে দাঁড়িয়ে থাকবেন। হাত তুলতে তুলতে ব্যথা হয়ে যাবে কিন্তু গন্তব্যে যাওয়া হবে না।
সার্জেন্ট ডাকবেন?

তাতেও লাভ হবে না। সার্জেন্ট এসে হয়তো হাউকাউ করবেন। হয়তো জরিমানা করবেন। কিংবা আপনাকে সিএনজিতে তুলে, ড্রাইভারের ঘাড়ে-গর্দানে দুটো দিয়ে মিটার চালাতে বলবে। আপনি ভাববেন বাঁচা গেলো।

ভুল ভাঙতে সময় লাগবে না। মাঝপথে সিএনজিওয়ালা গাড়ি থামিয়ে বলবে আর যাবে না। ইঞ্জিনে ডিস্টার্ব দিচ্ছে। কিংবা গাড়িতে গ্যাস নাই। মাঝপথে নেমে আপনি পড়বেন মাঝ দরিয়ায়। না যেতে পারবেন রিকশায় না অন্য কিছুতে।

সম্প্রতি এই বিড়ম্বনায় যুক্ত হয়েছে নতুন আপদ।

সিএনজিচালক যে ভাড়া দাবি করবে সেটা মেনে নিয়েই আপনার দায়িত্ব শেষ হয়েছে ভাবলে চলবে না।
আরও একটা কাজ করতে হবে।

গাড়িতে উঠে বসার সাথে সাথে চালক আপনাকে বলবে, মামা হলুদ পুলিশ ধরলে কইবেন মিটারে যাইতেছেন। পুলিশের জ্বালায় শান্তি নাই।
হাসি মুখে আপনাকে সিএনজিওয়ালার এই দাবির সঙ্গেও একমত পোষণ করতে হবে।

ডাবলেরও বেশি ভাড়া দিয়ে যাবেন। তার সাথে মিথ্যা কথা বলা বাধ্যতামূলক।
কোন দেশে আছেন বুঝতে পারছেন তো?

সিএনজির এই বিড়ম্বনা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। হচ্ছে। এমনকি সিএনজি পাওয়া যে কতটা ভাগ্যের ব্যাপার তা নিয়ে টিভিতে বিজ্ঞাপনও হয়েছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি।

জিম্মি নাটক এখনও চলছে। প্রথম দিকে প্রতিটি সিএনজি অটো রিক্সায় পুলিশ কন্ট্রোল রুমের নাম্বার লাগানো ছিল।

এরপর দিন অনেক গেছে। অনেক রোদ উঠেছে। অনেক বৃষ্টি হয়েছে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মেয়াদ-উত্তীর্ণ সিএনজি অটোরিক্সার বডি থেকে সে নাম্বারও নাই হতে বসেছে। কিছু গাড়িতে যাওবা আছে, তবে তা না থাকােই মতো। খালি চোখে দেখা যায় বলে মনে হয় না।

হতে পারে পুলিশ বিভাগ সমস্যাটিকে আর সমস্যা মনে করছে না। কিংবা এমনও হতে পারে, সমস্যার সমাধান তাদের নাগালের বাইরে কিংবা তাদের কেউ কেউ হয়তো চান থাকুক না কিছু সমস্যা!

পলাশ মাহবুব : সাহিত্যিক ও নাট্যকার।
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।