ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সাদাসিধে কথা

প্রশ্নপত্র ফাঁস কী অপরাধ নয়?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৫ ঘণ্টা, মে ৯, ২০১৪
প্রশ্নপত্র ফাঁস কী অপরাধ নয়? মুহম্মদ জাফর ইকবাল / ছবি: ফাইল ফটো

আমি খুব আশাবাদী মানুষ। আমার পরিচিত মানুষেরা আমার এই লাগামছাড়া আশাবাদ দেখে খানিকটা কৌতুক অনুভব করেন, আমি তাতে কিছু মনে করি না।

তার প্রথম কারণ এই আশাবাদের কারণে আমি অন্যদের থেকে অনেক বেশি আনন্দে দিন কাটাই। দ্বিতীয় কারণ আমার দীর্ঘ জীবনে আমার বেশিরভাগ আশাবাদই সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

এই দেশ নিয়েও আমি সবসময় খুব আশাবাদী, আমরা নিজের চোখেই দেখছি দেশটি আর দারিদ্যে মুখ থুবড়ে পড়া দেশ নয়। দেশটির অর্থনীতি আগের থেকে অনেক বেশি শক্ত; অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী পাশের দেশের মানুষের থেকে আমাদের দেশের মানুষ অনেক বেশি শান্তিতে আছেন এরকম তথ্য আমি অমর্ত্য সেনের লেখা থেকে জেনেছি। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের অর্থনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের দেশের গার্মেন্টের মেয়েরা, প্রবাসী শ্রমিকেরা এবং ক্ষেতখামারের চাষীরা। আমাদের মতো শিক্ষিত মানুষেরা এখনো দেশের অর্থনীতিতে সেরকম কিছু দিতে পারেনি; কিন্তু আমি সেটা নিয়ে মোটেও নিরাশ নই। আমি সবসময় জোর গলায় বলি, আমাদের দেশের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাই হচ্ছে প্রায় তিন কোটি (কানাডার লোকসংখ্যার সমান!)। আর এ ছাত্রছাত্রীরা ঠিকভাবে লেখাপড়া শিখে যখন খেটে খাওয়া মানুষজনের পাশে দাঁড়াবে তখন দেশের চেহারাটাই যাবে পাল্টে । আমি অনেক জোর দিয়ে এ কথাটি বলতাম, কিন্তু গত সপ্তাহের পর থেকে এ কথাটি বলার আগে আমার বুক থেকে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসছে। গত সপ্তাহে আমি নিশ্চিত হয়েছি এই দেশে পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন নিয়মিত ফাঁস হয়েছে যাচ্ছে এবং আমাদের দেশের সরকার নিয়মিতভাবে সেটা অস্বীকার করে যাচ্ছে।

পরীক্ষা লেখাপড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের মত দেশে পরীক্ষাটা আরো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ সব ছাত্রছাত্রীই পরীক্ষায় ভালো করতে চায়। তাই পরীক্ষাটি যদি খুব ভালো ভাবে নেওয়া যায়, অর্থাৎ পরীক্ষা পদ্ধতিটি যদি সঠিক হয়, তাহলে এই পরীক্ষায় ভালো করার চেষ্টা করতে গিয়েই ছেলে মেয়েরা সবকিছু শিখে ফেলে। আমাদের যদি ভালো স্কুল না থাকে- কিন্তু খুব চমৎকার একটা পরীক্ষা-পদ্ধতি থাকে, তাহলেও আমরা লেখাপড়ায় অনেক এগিয়ে যাব। দেশে যখন সৃজণশীল পরীক্ষা-পদ্ধতি এসেছে, আমরা তখন খুব খুশী হয়েছিলাম, মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে ছাত্রছাত্রীদের আর মুখস্থ করতে হবে না, এখন তারা চিন্তাভাবনা করে মাথা খাটিয়ে লেখাপড়া করতে পারবে। আমি একটিবারও ভাবিনি আমার দেশের সরকার, সরকারের শিক্ষাব্যবস্থা এই পরীক্ষার ব্যাপারে তাদের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে থাকবে, তারা প্রত্যেকটা পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হতে দেবে আর সেটি নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র দায়িত্ববোধ থাকবে না। এই সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আমি অনেক কাজ করেছি- এখন আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এই মন্ত্রণালয়টির দিকে তাকিয়ে থাকি আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না, যখন দেখি এই দেশের এতো বড় বিপর্যয় নিয়ে তাদের কোনো রকম প্রতিক্রিয়া নেই!

শুধু যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া নেই তা নয় পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোরও সেরকম প্রতিক্রিয়া নেই। আমি যে খবরের কাগজটি পড়ি সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার খবর ছাপা হয়নি, সম্পাদকীয় লেখা হয়নি, দেশের গুণীজন উপ-সম্পাদকীয় লিখেন নি। টেলিভিশন দেখার সুযোগ পাই না তাই সেখানে কী হচ্ছে জানি না, কিন্তু ছোটখাট বিষয়ের জন্যেও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আমার মতামত নিতে চলে আসে। এবারে কেউ আসেনি; শুধুমাত্র একটি চ্যানেল আমার কাছে সেটি জানতে চেয়েছে। তা-ও সেটি ঘটেছে কারণ আমি ফাঁস হওয়া প্রশ্ন এবং পরীক্ষার প্রশ্ন পাশাপাশি বসিয়ে খবরের কাগজগুলোতে একটা লেখা লিখেছিলাম। এই কাজটুকুও আসলে আমার করার কথা নয়, এটি করার কথা সাংবাদিকদের।

কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টি সংবাদমাধ্যমের কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াতে পুরো জাতি অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে থাকে এবং এটি আসলে এখন প্রচার করার মতো কোনো খবর নয় বলে পত্রপত্রিকা বিশ্বাস করে থাকে তাহলে এর থেকে বড় বিপদে আমরা আগে কখনো পড়েছি বলে মনে হয় না।

নিজের চোখে ফাঁস হয়ে যাওয়া এইচএসসি এর প্রশ্নপত্র দেখার পর আমি খোঁজ খবর নিয়েছি এবং আমি এখন নিশ্চিতভাবে জানি পিএসসি এবং জেএসসি এর প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছিল। এই ছোট ছোট শিশুগুলোর মা-বাবা কিংবা শিক্ষকরা তাদের হাতে প্রশ্নপত্রগুলো তুলে দিয়ে তাদের সেটা পড়িয়েছে।

শিশুগুলো সেগুলো পড়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে হুবহু সেগুলোই পরীক্ষায় এসেছে। তখন তাদের মনে বিস্ময়-আতংক কিংবা ক্ষোভ জন্মেছে কী না জানি না; কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি, এটি ছিল শিশুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতি শেখানোর প্রথম পদক্ষেপ। একটি দুটি শিশু তাদের আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে অন্যায় করতে শিখে যেতে পারে, কিন্তু একটি রাষ্ট্র দেশের পুরো শিশু-সমাজকে দুর্নীতি করতে শেখাতে পারে এটি সম্ভবত পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেনি।

আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘটনাগুলো স্বীকার করেনি। তাই এরকম কাজ যে অন্যায় বাংলাদেশের কেউ এখনো সেটা জানে না। যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে তারা এই দেশের আইনে এখনো অপরাধী নয়। অপরাধীর শাস্তি অনেক পরের। ব্যাপার কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস করা যে অপরাধ এই সরকারের এখনো সেই ঘোষণাটিও দেয়নি। সরকার যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এই বিষয়টি স্বীকারই না করে তাহলে এতো বড় একটা অপরাধ করার জন্য কাউকে শাস্তি কিভাবে দেবে? যারা প্রশ্ন ফাঁস করার সাথে জড়িত, যারা এদেশের পুরো শিক্ষা-ব্যবস্থাকে ধূলার সাথে মিশিয়ে দিয়েছে তাদের কে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া যাবে না --এর কারণটি কি আমি বুঝতে পারছি না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি এটাকে একটা অন্যায় মনে করে থাকে এবং অপরাধের বিষয়টা নিয়ে মুখ না খুললেই মানুষ বিষয়টি ভুলে যাবে, তাহলে তাদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে সেটি সত্য নয়। এই দেশের প্রত্যেকটি মানুষ ঘটনার কথা জানে, বিশেষ করে যেসব তরুণ তরুণী তাদের এই প্রশ্নফাঁসের কারণে হতাশায় ডুবে গেছে তাদের অভিশাপ থেকে কিন্তু কেউ মুক্তি পাবে না।

২.
আমার কাছে যখন একটি মেয়ে প্রথমবার ফোন করে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাবার কথা জানিয়েছে তখন তার কাছে আমি ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলো চেয়েছিলাম। পরীক্ষা হওয়ার পর সে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রটিও পাঠিয়েছিলো। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া ছাড়াও পরীক্ষার প্রশ্নটি দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম অন্য কারণে। লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী যে পরীক্ষা দিচ্ছে, সে পরীক্ষার প্রশ্নটি এতো অযত্নে কেমন করে তৈরি করা হলো? প্রশ্নে যে জঘণ্য ছবিগুলো ব্যবহার করা হয়েছে এর চাইতে রুচিসম্মত সুন্দর ছবি আঁকার মতো প্রশ্ন প্রণয়ণ করে কমিটিকে সাহায্য করার কেউ কি নেই?

সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, একটা সমস্যা সমাধান করার জন্য ধ্রুবকগুলোর যে মানটুকু জানানো প্রয়োজন সেটি টাইপ করে লেখারও কেউ প্রয়োজন মনে করেনি। অত্যন্ত অবহেলায় প্রায় দুর্বোধ্য হাতের লেখায় প্রশ্নপত্র লিখে দেওয়া হয়েছে। দেখেই বোঝা দায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, টাইপ বা ছাপা পুরো ব্যাপারে কারো বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই। আমি বিশ্বাস করতেই রাজি নই যে, গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে করা সম্ভব ছিলো না। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে যে চরম অবহেলা রয়েছে তার আরো অনেক প্রমাণ আছে। আমার কাছে অনেক ছাত্র-ছাত্রী অভিযোগ করেছে যারা ইংরেজি মাধ্যমে পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের প্রশ্নে অনেক বড় বড় ভুল রয়েছে, পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নে এমন ভুল আছে যার কারণে উত্তরে আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়ে যেতে পারে। অবহেলা ছাড়াও আরো সমস্যা আছে। ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ করেছে জীববিজ্ঞান পরীক্ষার শতকরা ৮০ ভাগ প্রশ্ন গাইডবই থেকে নেওয়া হয়েছে। তারা আমার কাছে গাইডবইটির নামও উল্লেখ করে দিয়েছে। আমি সাংবাদিক নই, সাং বাদিক হলে তাদের অভিযোগ যাচাই করে দেখতে পারতাম। এই মুহুর্তে আমার যাছাই বাছাই করার সুযোগ নেই। কিন্তু  এটি নিশ্চয় যাচাই করে দেখা সম্ভব। যদি দেখা যায়, সত্যিই প্রশ্নগুলো গাইডবই থেকে নেওয়া হয়েছে  তাহলে কী সরাসরি যারা প্রশ্ন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না?

কেউ আমাকে বলতে পারবেন, এই দেশের ইতিহাসে তো কতোবার কতো প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে –কিন্তু কখনো কী কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? হাতে হাতকড়া লাগিয়ে কখনো কী কোনো মানুষখে হাজতে নেয়া হয়েছে?

ফেসবুক নামক একটি বিশেষ সামাজিক নেটওয়ার্কিং-এর কারণে আজকাল ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন সবার মাঝে  বিতরণ করা খুবই সহজ হয়ে গেছে। এই একটি দিকে বাংলাদেশ সত্যিকার  ডিজিটাল যুগে পা দিয়েছে ! মাঝে মাঝে দেখতে পাই কমবয়সী তরুণেরা ফেসবুকে  বেফাঁস কোনো কথা বলে দেওয়ার কারণে পুলিশ কিংবা ৠাবের হাতে ধরা পড়ছে, জেল খাটছে। কিন্তু ফেসবুক ব্যবহার করে প্রকাশ্যে যখন ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন  নিয়ে বাণিজ্য করা হয় তখন কেন কখনো তাদের কাউকে  ধরা  হয় না ? তারা কীভাবে সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়?

আমি কী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে খুব স্পষ্ট করে কয়েকটি প্রশ্ন করতে পারি? সত্যি কী প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে ? যদি ফাঁস হয়ে থাকে তাহলে সেটি কি অপরাধ? যদি অপরাধ  হয়ে থাকে তাহলে সেই অপরাধীদের ধরার জন্যে কী কোনো মামলা করা হয়েছে? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেকের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে, অনুগ্রহ করে আপনাদের কেউ কী আমার এই প্রশ্নটির উত্তর দেবেন?

৩.
প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমি গত সপ্তাহে একটা ছোট লেখা লিখেছিলাম, তারপর অনেকেই আমার সাথে যোগাযোগ করে কীভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা যায়, সে সম্পর্কে নানা পদ্ধতির কথা বলেছেন।

সত্যি কথা বলতে কী যতক্ষণ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁস করার ব্যাপারটি সরকার স্বীকার করবে না, সেটাকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে অপরাধীদের ধরে শাস্তি দেবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তথ্য প্রযুক্তির কোনো পদ্ধতিই আসলে কাজ করবে না।

সরকার যদি এই ভয়ঙ্কর ব্যাপারটি ঘটছে সেটা ঘোষণা দিয়ে স্বীকার করে নিয়ে অপরাধীকে ধরার চেষ্টা করে তাদের ভয়্ঙ্কর শাস্তি দিতে শুরু করে তাহলে আর কিছুই করার প্রয়োজন হবে না। এখন যে পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়, বিতরণ করা হয়, সেই পদ্ধতিতেই প্রশ্ন ফাঁস হতে না দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া যাবে।

সত্যি কথাটি হচ্ছে প্রশ্ন আসলে ফাঁস হয় না, প্রশ্ন ফাঁস হতে দেওয়া হয়।

৪.
এই দেশের ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে ক’দিন ধরে আমার মনটা খুব খার‍াপ। পি.এস.সি কিংবা জে.এস.সি পরীক্ষা দেওয়া শিশুদের ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি দেওয়া হয়। যারা বৃত্তি পেয়েছে তারা আমাকে চিঠি লিখে বলেছে, যদিও তারা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ছাড়াই পরীক্ষা দিয়েছে, কিন্তু সবাই এখন তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে নানা রকম কটূক্তি করছে।

যারা বৃত্তি পায়নি তাদের অনেকে আমাকে জানিয়েছে, তাদের থেকে খারাপ পরীক্ষা দিয়ে অনেকে বৃত্তি পেয়ে গেছে, কারণ তাদের উপরের মহলে ধরাধরি করার লোক আছে। যেহেতু সাধারণের কাছে গোপন পরীক্ষায় পাওয়া আসল নম্বরের ভিত্তিতে এই বৃত্তি দেওয়া হয়, তাই এই পুরো পদ্ধতিটাই আসলে ভয়ংকর রকম অস্বচ্ছ! এই শিশুদের অভিযোগ সত্য নয়- এই কথাটি পর্যন্ত কেউ জোর দিযে বলতে পারবে না। গ্রেডিং প্রদ্ধতি চালু করে নম্বর তুলে দেয়া হয়েছে- কিন্তু সেই নম্বর দিয়ে একটা ছাত্র বা ছাত্রীর ভবিষ্যতও নির্ধারণ করা হয় এবং কেউ কোনোদিন সেটা জানতে পারবে না, এতো বড় একটা অস্বচ্ছ ব্যাপর কীভাবে সবাই দিনের পর দিন সহ্য করে যাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না।

যারা  এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে তারা একটু বড় হয়েছে এখন তাদের সেই বয়স যে বয়সে তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করার আগেই তাদের স্বপ্ন ভেঙে দেয়া হচ্ছে এবং সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপর সেটি করছে তারাই যাদের স্বপ্ন দেখানোর  কথা। যারা ফাঁস করা প্রশ্নপত্র পেয়ে সেটা পড়ে পরীক্ষা দিয়েছে তাদের ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে। শুনেছি ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য লেখাপড়া করতে বসিয়ে মায়েরা ফেসবুক একাউন্ট তৈরি করে সেখান থেকে ছেলেমেয়েদের জন্য ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন বের করে এনেছেন। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্রে যারা পরীক্ষা দিয়েছে তারা নিজেদের জন্য নানা ধরনের যুক্তি দাঁড় করিয়ে অপরাধবোধটা কমানোর চেষ্টা করছে এবং সেটি হচ্ছে দুর্নীতি শেখার প্রথম ধাপ। এই ছেলেমেয়েগুলো কিন্তু নিজে থেকে দুর্নীতি করতে চায়নি তাদের জোর করে দুর্নীতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

যারা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ব্যবহার না করে পরীক্ষা দিয়েছে তাদের ভেতর এখন একই সাথে তীব্র হতাশা এবং ক্ষোভ। তাদের মুখে একটিই কথা “ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দিয়েই যদি সবাই পরীক্ষা দিয়ে ভালো নম্বর পাবে, তাহলে সারা বছর এত  মনোযোগ দিয়ে পড়ে আমার কী লাভ? এইচএসসি পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে, তখন এই ছেলেমেয়েগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা তাদেরকে সত্য ও ন্যায়ের কথা বলি কিন্তু অসত্য আর অন্যায়কে লালন করি- এত বড় ভণ্ডামির উদাহরণ কেউ কি আর দিতে পারবে?

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বড় বড় হর্তাকর্তারা, সরকারের বড় বড় লোকজন খুব শান্তিতে থাকেন। ছোট ছোট শিশুরা, এই দেশের কিশোর-কিশোরীরা তরুণ-তরুণীরা তাদের ধারেকাছে যেতে পারে না। তারা পুলিশের প্রহরায় গাড়ি করে যান, তাদের চিঠি পড়তে হয় না, ইমেইল দেখতে হয় না। এই শিশুকিশোর তরুণেরা কিন্তু আমার মতো মানুষের কাছে আসতে পারে, যখন তীব্র ক্ষোভ নিয়ে আমার কাছে অভিযোগ করে তখন আমি তাদেরকে কী বলে সান্ত্বনা দেবো বুঝতে পারি না।

তারপরও আমি তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি, আমি তাদেরকে বোঝাই শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হবে। অন্যায়কে অন্যায় বলা হবে, অপরাধকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সমস্ত আবর্জনা ধুয়েমুছে ফেলে নতুন করে সব কিছু শুরু করা হবে। আমাদের প্রজন্মের মানুষেরা যে কাজটি করতে পারেনি নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই সেই কাজ করতে পারবে।

আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ, বড় শক্তি হচ্ছে এই স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। দেশের সব মানুষের কাছে করজোরে অনুরোধ, তাদের অবহেলা করে ঠেলে দেবেন না। তাদেরকে আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বড় হতে দিন।

বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, মে ৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।