আমরা আগেই বলেছিলাম টিকফা হবে বাংলাদেশের জন্য গলার ফাঁস। টিকফার মত দ্বিপাক্ষিক চুক্তির অর্থনৈতিক দর্শন হচ্ছে নিওলিবারেল পলিসি অর্থাৎ আমাদের মত দেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিতে হবে বহুজাতিক কোম্পানির জন্য, আমাদের সেবা খাতসহ বিভিন্ন সেক্টরকে বেসরকারিকরণ ও বিনিয়ন্ত্রণ করে বাইরের কোম্পানির বিজনেসের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে এবং একই সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানিকে ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট দিতে হবে।
১. যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে মার্কিন ওষুধ কোম্পানির ডায়াবেটিক ওষুধ আমদানির জন্য চাপ দিয়ে গেল। বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোই দেশের ডায়াবেটিক ওষুধের (ইনসুলিন ছাড়া) চাহিদা পূরণ করছে এবং এদেশের ওষুধের গুণগত মান ভালই। ১৯৮২’র ওষুধ নীতির আগে এদেশের ওষুধের বাজার ছিল আমদানি নির্ভর, এই ওষুধ নীতির ফলে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির উপর নির্ভরতা বাদ দিয়ে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোই উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করে। টিকফার মূল বিষয়ই হচ্ছে এদেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিতে হবে মার্কিন কোম্পানির জন্য। মার্কিন ডায়াবেটিক ওষুধ আমদানির বিষয়ে আলোচনা এদেশের ওষুধের বাজার উন্মুক্তকরণের শুরু মাত্র, এরপর একসময় যুক্তরাষ্ট্র বলবে অমুক ওষুধও আমদানি কর, তমুক ওষুধ আমদানি কর। বাংলাদেশের দুই/ তিনটি কোম্পানি মোটামুটি ভাল মানের ইনসুলিন প্রস্তুত করছে কিন্তু দেশে এখনও উন্নত ইনসুলিনের ক্রাইসিস আছে। ফলে গ্লোবাল কোম্পানি থেকে সাময়িকভাবে ইনসুলিন আমদানি করা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে উন্নতমানের ইনসুলিন কিনতে আমাদের কোন প্রব্লেম নাই, কিন্তু প্রব্লেম হচ্ছে আমাদের ন্যায্য অধিকার জিসপি সুবিধা না দিয়ে কেবল বাংলাদেশকেই মার্কিন কোম্পানির বাজারে পরিণত করার জন্য সব মেনে নিতে হবে কেন?
২. যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তা দানের জন্য আমাদেরকে মার্কিন কোম্পানি থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল এবং সেফটি ইকুইপমেন্ট কেনার জন্য বলছে, এবং তার জন্য আমদানি শুল্ক ১৫০% থেকে কমিয়ে এনে ১৫% করতে বলছে, কিন্তু নিজে আমাদের পোশাক এর উপর আরোপিত ১৫.৬২% শুল্ক কমিয়ে ২.২৯%ও (ভারতের মত) করতে রাজি হচ্ছে না কেন? উল্লেখ্য ডব্লিউটিওর নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ এমনিতেই এই শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার মার্কিন বাজারে পাওয়ার কথা! যেখানে চীন, ভারত, হংকং এবং ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রকে যথাক্রমে ৩, ২.২৯, ১.২৫ এবং ৮.৩৮% ট্যারিফ দেয় সেখানে বাংলাদেশকে কেন স্বল্পোন্নত দেশ হয়েও ১৬% শুল্ক বহন করতে হবে? বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বৈঠকে প্রতিনিধিত্বকারী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ স্পষ্ট করেই মার্কিন প্রতিনিধিদলের কাছে বলেছেন, অনুন্নত (এলডিসিভুক্ত) অনেক দেশই শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু এলডিসিভুক্ত রাষ্ট্র হয়েও এসব সুবিধা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এ সুবিধা পাওয়া বাংলাদেশের অধিকার (আমাদের সময়, ২৮ এপ্রিল, ২০১৪)। কিন্তু বাংলাদেশকে এই ন্যায্য অধিকার প্রদানে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দলকে মোটেই আন্তরিক মনে হয়নি, শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধার বিষয়টি ডব্লিউটিওর আওতায় বিবেচনাধীন বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইক ডিলানি। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আর্বিট্রেশন সেন্টারের প্রধান নির্বাহী তৌফিক আলী আক্ষেপ করে বলেন, ‘ডব্লিউটিতে আলোচনার সময় শুল্ক সুবিধার বিষয়টি এলে যুক্তরাষ্ট্র নিজের দেশের আইনের কথা তোলে। আবার দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় শুল্ক সুবিধার বিষয়টি এলে ডব্লিউটির দোহাই দেয় যুক্তরাষ্ট্র’। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বহুপাক্ষিক এবং দ্বিপাক্ষিক কোন পরিসরেই বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক সুবিধা দিতে রাজি হচ্ছে না। তাহলে এতো আগ্রহ নিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা হল কেন? মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের শুল্ক মুক্ত সুবিধা দানের বিষয়টি ডব্লিউটিও’র দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডার আওতাধীন বলে নাকচ করে দিয়েছেন কিন্তু টিকফা চুক্তির ১৩ এবং ১৪ নং প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশকে দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা অনুসারে কৃষিতে ভর্তুকি কমানো এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করতে হবে। শুল্ক মুক্ত সুবিধার বিষয় দোহা ঘোষণার অন্তর্ভুক্ত হলে একইভাবে এই চুক্তির ১৩ এবং ১৪ নং প্রস্তাবনাও বাতিলযোগ্য। মাইক ডিলানিকে দোষ দিয়ে লাভ নাই, দোষ আমাদের কর্মকর্তাদের যারা টিকফা চুক্তিতে স্বাক্ষরের জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন- এই চুক্তিতে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কোন নিশ্চয়তা রাখা হয়নি কারণ চুক্তির ৭ নম্বর প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় দেশ নিজ নিজ বাজারে পণ্য প্রবেশে নন ট্যারিফ বা অশুল্ক বাধা দূর করবে। চুক্তির এই ধারার কারণেই ডিলানি বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত সুবিধা নাকচ করে দিতে পেরেছেন। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় কোন বিশ্লেষণ ছাড়াই সব মেনে নিলে তো দরকষাকষিতে বিপাকে পড়বেন এটাই স্বাভাবিক। শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার কিছুই নেই যখন টিকফা চুক্তিতে তখন এই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধা বাড়বে বলে প্রচার প্রোপাগান্ডা চালিয়ে এই চুক্তি সই করার জন্য জনমতকে ধোঁকা দেয়ার কাজ কেন করা হয়েছে? এতদিন আমাদের বলা হয়েছিল এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতা দূর করবে এবং বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি করবে। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির কথায় সে আশায় এখন গুড়ে বালি। এশিয়ার দুটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি গণচীন এবং ভারত তার রপ্তানির যথাক্রমে ২১ এবং ১৯% পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করলেও তারা এ চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। অর্থাৎ টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে প্রধান বাধা হচ্ছে শুল্ক বাধা। চীন টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর না করেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম শুল্কে পণ্য রপ্তানি করতে পারছে। চীন, ভারত টিকফা স্বাক্ষর না করেই যদি মাত্র ৩% এবং ২.২৯% শুল্ক দেয় আর বাংলাদেশ নিজের অনেক ক্ষতি মেনে নিয়েও ১৫.৬২% শুল্ক বহন করতে হয় তাহলে এই চুক্তি বহাল রাখার কোন মানে হয় না! আবার এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ নন ট্যারিফ বা অশুল্ক বাধা দূর করলে তা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অশুল্ক বাধা হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের শিল্প, কৃষি সহ সামগ্রিক অর্থনীতিকে বহুজাতিক কোম্পানিসহ উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক আগ্রাসন থেকে রক্ষার সর্বশেষ রক্ষাকবচ। বিদেশি কোম্পানির পণ্য আমদানিতে নানান অশুল্ক বাধা আরোপ করে বাংলাদেশ তার নিজের বাজার ও শিল্পের বিকাশ করতে পারে। কিন্তু এই নন ট্যারিফ বাধা অপসারণ করলে এদেশ হাইতির মত যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের একচেটিয়া বাজারে পরিণত হওয়ার আশংকা আছে! মার্কিন বহুজাতিক এগ্রো-কেমিক্যাল করপোরেশন মনসেন্টো, ইউনিলিভার, ডুপন্ট এর জিএম হাইব্রিড শস্য বীজের আগ্রাসন বাংলাদেশের কৃষিতেও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে এবং এসব কোম্পানির জিএম ফুডে সয়লাব হয়ে যাবে এদেশের বাজার!

৪. টিকফার প্রস্তাবনায় মানবাধিকার, শ্রমের মান এবং শ্রমজীবীদের অধিকার ও পরিবেশগত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তার লক্ষ্য শ্রমজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নয় বরং এগুলোকে নন-ট্যারিফ বাধা হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তার বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। প্রথম বৈঠকেই প্রমাণিত হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র এসব বিষয়কে অশুল্ক বাধা হিসেবে ব্যাবহার করে বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধা লাভের বিষয়টি ঠেকিয়ে রাখবে। বৈঠকে বাংলাদেশের জিএসপি ফিরে না পাওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র শ্রমিক নিরাপত্তা এবং ট্রেড ইউনিয়ন না করাকেই দায়ী করেছে।
টিকফার প্রথম বৈঠকেই এটা প্রমাণিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই টিকফা চুক্তিকে কাজে লাগাবে এবং এ চুক্তিতে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ক্ষতি ছাড়া লাভের পরিমাণ সামান্যই। প্রথম বৈঠকের পরও যারা টিকফার মাধ্যমে দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থ সুরক্ষার স্বপ্ন দেখেন তাদের জন্য বলছি— এ চুক্তির বিভিন্ন প্রস্তাবনায় (২, ৩, ৫, ৬,৭) এবং অনুচ্ছেদে (১, ৩) বাজার উন্মুক্তকরণ এবং সেবাখাতের ঢালাও বেসরকারিকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সেবা খাতগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। এ চুক্তির ২, ৩, ৫, ৭ এবং ১৫ নম্বর প্রস্তাবনার মাধ্যমে বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষাসহ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে সেবাখাতে বাণিজ্যের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে (বেসরকারিকরণ, সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য নীতি বাদ দিয়ে ওপেন মার্কেট পলিসি নিরঙ্কুশভাবে গ্রহণ, নন ট্যারিফ বাধা অপসারণ ইত্যাদি) দেশের জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি সেক্টরকে মার্কিন পুঁজিপতিদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। ফলে চুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে দেশের সেবাখাতগুলো রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির দখলে চলে যাবে। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ তার নিজস্ব প্রয়োজন অনুসারে কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি প্রদানের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারাবে। ফলে বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্যের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাবে। এই চুক্তিতে তো বিধান আছে যে কোন পক্ষ চাইলে চুক্তি বাতিল করতে পারবে এবং তা ১৮০ দিনের মধ্যেই কার্যকর হবে। আমরা মনে করি সামগ্রিক বিবেচনায় এই চুক্তি বাতিলই হবে বাংলাদেশে জনগণের জন্য কল্যাণকর।
লেখক : শিক্ষক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি এন্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১১২৪ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৪