ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে দেশে তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সারা দেশে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার মতো ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দু’জনের বেশি নেই, বিষয়টি সংবাদপত্র খুব ফলাও করে প্রচার করেছে।
আমি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখি নি। ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্যে কী কী যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে তার খুঁটিনাটিও জানি না। কিন্তু শুধু কমনসেন্স ব্যবহার করে খুব জোর গলায় বলতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ার যোগ্যতা এ দেশে অনেক ছেলে-মেয়েরই আছে। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের অসংখ্য ছেলে-মেয়ে পৃথিবীর যেকোনো দেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো বিভাগে পড়ার মতো যোগ্যতা রাখে। আমি যদি তাদের খুঁজে বের করতে না পারি তাহলে তার দায়-দায়িত্ব ছাত্র-ছাত্রীদের নয়, শিক্ষাব্যবস্থারও নয়; তার দায়দায়িত্ব যারা খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের।
আমরা সবাই জানি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক সমস্যা আছে; কিন্তু তার ভেতরে থেকেও অসংখ্য ছাত্রছাত্রী নিজের আগ্রহ নিয়ে লেখাপড়া করে এবং হাজার প্রতিবন্ধকতা দিয়েও তাদের ঠেকিয়ে রাখা যায় না। তাই আমি যখন পত্র-পত্রিকায় দেখি সারা বাংলাদেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগে ভর্তি হওয়ার মতো ছাত্র-ছাত্রী দু’জনের বেশি নেই, শুনে আমি অত্যন্ত বিচলিত হই। আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের সারা দেশের সামনে হেয় করার এই দায়িত্বহীন প্রচারণা দেখে আমি ব্যথিত হই।
আমি মনে করি, পুরো বিষয়টি ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করার জন্য হাইকোর্ট একবার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি তখন তাদের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি সেবার ভয়ংকর এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের প্রতিটি কোনো না কোনো গাইড বই থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন করার কাজটি সহজ নয়Ñ মান যাচাই করার পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন হয় এক রকম, ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছেঁকে নেওয়ার প্রশ্ন হয় সম্পূর্ণ অন্য রকম। ছেঁকে নেওয়ার প্রশ্ন দিয়ে মান যাচাই করার চেষ্টা করা কোনোভাবেই সঠিক নয়।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা নিয়ে যত খুশি সমালোচনা করা যেতে পারে; কিন্তু আমাদের ছেলে-মেয়েদের দক্ষতা বা মান নিয়ে সমালোচনা করলে সতর্কভাবে করতে হবে। তাদের দায়িত্বহীনের মতো হতাশার পথে ঠেলে দেওয়া যাবে না। আমরা যারা পড়াই, প্রশ্ন করি, পরীক্ষা নিইÑ তারা সবাই জানি, ইচ্ছে করলেই এমনভাবে প্রশ্ন করা সম্ভব ছাত্র-ছাত্রীরা যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। ছাত্র-ছাত্রীদের আটকানো যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয়, কাজটি পানির মতো সহজ। আমরা কি সেটাই করতে চাই? আমরা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার মান নিয়ে এত বড় বড় কথা বলি, সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান কোথায়, সেটি নিয়ে যদি উল্টো ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের প্রশ্ন করে বসে, আমরা কি তার উত্তর দিতে পারব? আমরা তখন কোথায় গিয়ে আমাদের মুখ লুকাব?
ভর্তি পরীক্ষার এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে আমার ভেতরে খুব আগ্রহ কি সম্মানবোধ কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। সংবাদপত্রগুলোকে আমি বহু দিন থেকে অনুরোধ করে আসছি, তারা যেন একবার এই ভর্তি প্রক্রিয়ায় (কিংবা ভর্তি বাণিজ্য, যেটাই বলি) ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে কত টাকা আদায় করা হয়, তার ভেতর থেকে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য নানা কাজে কত টাকা খরচ হয় এবং কত টাকা সম্মানী হিসেবে শিক্ষকরা ভাগাভাগি করে নেন তার একটা তালিকা প্রকাশ করে, তাহলে ভর্তি পরীক্ষা নামের এই ভয়ংকর অমানবিক ও চূড়ান্ত অস্বচ্ছ বিষয়টা সবার সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সম্মিলিতভাবে একটা ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কথা বহু দিন থেকে আলোচিত হয়ে আসছে। প্রকাশ্যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তার বিরোধিতা করে না, কিন্তু ঠিক সময়টিতে কেউ তার উদ্যোগ নেয় না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে গত বছর একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, যুব ইউনিয়ন, জাসদÑএ রকম বামপন্থী দলগুলো তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সেটি বিএনপি-জামায়াতের হাতে তুলে দেয় (যারা এই বাক্যটি পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন তাদের ঠান্ডা মাথায় আরো একবার বাক্যটি পড়ার অনুরোধ করছি)। পরীক্ষার দিন হরতাল ডাকা হবে এ রকম হুমকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে দেওয়া হয়!
রাজনৈতিক দলগুলো যাই ভাবুক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভর্তি প্রক্রিয়াতে যত টাকাই উপার্জন করুন না কেন, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের নিয়ে যতই অহংকার করুক না কেন, আমি মনে করি, সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়া হচ্ছে এই দেশের ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেওয়ার নামে অমানবিক যন্ত্রণা (এবং নতুন যোগ হওয়া অপমান) বন্ধ করার একমাত্র উপায়।
এ ধরনের একটি প্রক্রিয়া চালু করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তার প্রতিটি ধাপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে এবং কাজে লাগানো হয়েছে। প্রযুক্তিগত প্রতিটি বিষয় সমাধান করা হয়েছে (অর্থ উপার্জন কমে যাবে বলে যারা বলেন এটা করা সম্ভব না তাদেরও ভরসা দিয়ে বলা যায়, তারা এই নতুন পদ্ধতিতেও যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে পারবেন!)।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত, তাই তারা কারো কথা শুনতে বাধ্য নয় এতদিনে আমি টের পেয়ে গেছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কখনোই নিজে থেকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবে না!
আমার জানামতে, এখন একটি মাত্র পথ খোলা আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের ডেকে একটি নির্দেশ দেন যে সামনের বছর থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে হবে, তাহলেই সেটি সম্ভব। তা না হলে সম্ভব নয়, ছাত্র-ছাত্রীদের বছরের পর বছর যন্ত্রণা-কষ্ট আর অপমান সহ্য করে যেতে হবে।
আমাদের ভাইস চ্যান্সেলররা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে মানেন না, শিক্ষামন্ত্রীর কথা শুনতে রাজি নন, কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অবাধ্য হওয়ার সাহস মনে হয় তাদের কারোরই হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১৪