কয়েক দিন আগে অনুজপ্রতিম শাহিন ফোন করে জানালেন নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না দুর্নীতির বিরুদ্ধে পান্থপথে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছেন। সেই মতবিনিময় সভায় আমার আমন্ত্রণ।
সেই সময়টাতে আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সামনে নিয়ে বৈরী স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটছিলাম। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের পাশে জাসদের বীভৎস রূপ আমাদের তাড়িত করেছিল। আমাদের লড়াইটা ছিল যেন একার। বঙ্গবন্ধুর হৃদয় নিসৃত আত্মসমালোচনা, আত্মসংযমের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভের পথ ধরেই আমরা হেঁটেছিলাম একটি অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে। স্বৈরতন্ত্রের জগদ্দল পাথর ছিল সেদিন জাতির বুকে। আজকের মতো তাকালেই শুধু চারদিকে আওয়ামী লীগ আর তার স্তুতিবাক্য এমনটি ছিল না। আজকের জাসদের মুখে আওয়ামী লীগ বন্দনা দেখলে মনে হয় হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র এ দেশ! কতই না দেখেছি, কতই না দেখার বাকি।
তারও আগে মস্কোর বৃষ্টিতে ঢাকায় ছাতা ধরা জিয়ার খালকাটা বিপ্লবের সহযোগীরা রিক্ত নিঃস্ব হয়ে মুজিবকন্যার আঁচল ধরে কীভাবে ক্ষমতার স্বাদ নেন। কেমন করে অতি বিপ্লবী চীনপন্থিরা মুজিব বিদ্বেষী রাজনীতির ঢোল বাজাতে বাজাতে বিপ্লবের কথা ভুলে গিয়ে সামরিক শাসকদের দাস ও ঝাড়ুদারে পরিণত হন। জাসদ তার ভুল রাজনীতির জন্য জাতির কাছে ক্ষমা না চান এই দলের অনেক স্রষ্টা নানা সময় করুণা আশ্রিত ক্ষমতার গ্লানিময় স্বাদ তো পেয়েছেন। তাদের দলের এবং প্রতিপক্ষের অনেক তরুণের রক্তস্নাত ভুলে ভরা ইতিহাস রচনা করে গেলেও জীবনেই তারা তাদের বিবেক নিয়ে ঘুমাতে গেলে নরক যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। যাক, বলছিলাম মাহমুদুর রহমান মান্নার কথা। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না কী করতে পারবেন আর কী পারবেন না সেটি আমার কাছে বড় নয়। সময়ই তার হিসাব বুঝিয়ে দেবে। সেদিন শুক্রবার রাতে ড. তুহিন মালিকের পারিবারিক অনুষ্ঠানে লেক শোরের ছাদে আমরা এক আনন্দ আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম। নানা মত পথের মানুষেরা একান্ত আড্ডায় মিলিত হলে যা হয় তাই হয়েছে। হাসাহাসি, টিপ্পনী, খোসগল্প অনেক হলেও পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সহমর্মিতার কোনো ঘাটতি হয়নি। হয়তো সামনেও হবে না। সেখানে মান্নাকে রসিকতা করে বলছিলাম, আন্না হাজারে হবেন কিনা জানি না, তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়। কারণ রাজনীতি ও দেশ যেমন চলছে প্রতি সরকারের আমলেই দুর্নীতির ডালপালা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দেখলাম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে তারা যে ঐক্য গড়েছেন সেখানে তার আশা এবং আগ্রহ আকাশছোঁয়া। তাই রসিকতা করে বলছিলাম, কেউ আদর্শবোধ নিয়ে ড. কামাল হোসেনের কাছে রাজনৈতিক ঐক্য গড়তে যান না। নেত্রী তাড়ানো, বাপে খেদানোরাই ছুটে যান। নিজের পায়ে কেউ দাঁড়ানোর মতো রাজনীতি করতে পারেননি বলে আজকের রাজনীতির এই করুণ দশা।
ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বের হওয়ার আগে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে আওয়ামী লীগ অব্যাহতি দিয়েছিল। দিয়েছিল মোস্তফা মহসিন মন্টুকেও। অনেকেই ড. কামাল হোসেনের গণফোরামে গিয়েছিলেন। ড. কামাল হোসেনকে যারা মার্কিন লবির কট্টরপন্থি বলে সমালোচনা করতেন সেসব দেউলিয়া বামরা আগে ছুটে গিয়েছিলেন। সেই তারাই তাকে রেখে আগেই বেরিয়ে আসেন। কেউ কেউ এই সরকারের মন্ত্রীও। জীবনের পড়ন্ত বেলায় ড. কামাল হোসেন অভিভাবকের মতো দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা ও সাংবিধানিক বিষয়ে তার অভিজ্ঞ মতামত দিয়ে গাইডলাইন দিতে পারবেন। কিন্তু ময়দানে নেমে গণজাগরণ ঘটিয়ে দেবেন এমন পরিস্থিতি তার আয়ত্তে নেই এটি সবাই জানেন।
তারপরও কোনো মানুষের কোনো সংগ্রামই বিফলে যায় না। গণফোরাম নামের দলটি কালো কোট পরা সতীর্থদের নিয়ে যেভাবে এগিয়ে এসেছিল সেভাবেই দ্রুত মাটিতে শুয়ে গেছে। কিন্তু ড. কামাল হোসেনের সুস্থ ধারার সৎ মানুষের রাজনীতির স্লোগান প্রতিদিন শহর থেকে গ্রামে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই পাচ্ছে। তাই অনেক সময় বলা হয়- ব্যক্তির মৃত্যু হয়, আদর্শের মৃত্যু হয় না। ভোগবিলাস, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, গুম-খুন, দমন-নির্যাতন আর দলীয়করণের উন্নাসিক রাজনীতি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলে আওয়ামী লীগ বা অন্য কেউ দেশ শাসন করলেও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে কিছু যায় আসে না।
কিন্তু এই সত্য চিরন্তন যে, বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে এই দেশের জনগণের মাঝ থেকেই একদিন একজন নেতা বেরিয়ে আসবেন। কংগ্রেস মানেই ভারতের রাজনীতি সেটি বাজপেয়ির বিজেপি ভুলিয়ে দিতে না পারলেও গুজরাট থেকে উঠে যাওয়া নরেন্দ্র মোদি দিয়েছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর দালালিতে যখন অনেক বড় বড় নেতা ব্যস্ত, বিভ্রান্ত যখন অনেক সিনিয়র নেতা, তখন টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে আসা সাহসী তরুণ যার লক্ষ্য ছিল নির্ধারিত, বুক ভরা ছিল আদর্শবোধ, চরিত্র ছিল নিষ্কলুষ নির্লোভ, দৃঢ়চেতা, মাটি ও মানুষের প্রতি যিনি ছিলেন কমিটেড সেই অমিত সাহসী পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে বৈরী স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে নিয়ে এসে এক সুতোয় বেঁধে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। ক্ষণজন্মা পুরুষেরা সময়ের প্রয়োজনে এভাবেই আবির্ভূত হন। পরিবর্তনের ঝড়ো তুফান তোলেন। সময়ের প্রয়োজনেই নষ্টদের হাতে চলে যাওয়া আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের নানা প্রতিষ্ঠানে সেই অমিত সাহসী পুরুষদের আবির্ভাবেই আমূল সংস্কার ঘটবে গণজাগরণের মধ্য দিয়ে। জনগণ সময়মতো জ্বলে উঠতে, ঐক্যের মিলিত মোহনায় দাঁড়াতে অতীতে ভুল করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না।
ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে জাসদের আ স ম রব, সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মনসুররা কতদূর যেতে পারবেন তা নিয়ে শতভাগ সংশয় থাকলেও, বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা সেই প্রশ্ন থেকে গেলেও বিশ্বাস ও আস্থার শতভাগ একটি জায়গায়ই সেটি হচ্ছে জনগণ।
জনগণের শক্তির চেয়ে কোনো বড় শক্তি আর কোথাও নেই। ড. কামাল হোসেন জ্ঞানী, পণ্ডিত মানুষ। মানুষের সঙ্গে তার ভাব বিনিময়ে বাগ্মিতার কারিশমা নেই। জীবনও পড়ন্ত বেলায়। এই বেলায় বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়া যায় না।
২. ভারতের আন্নার মতো এককালের ডাকসু বিজয়ী মান্নার দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। ইতিমধ্যে তিনি দুর্নীতিবিরোধী কয়েকটি পথসভাও করেছেন। তবে সাফল্য ব্যর্থতা নির্ভর করবে তার প্রতি জনগণের আস্থা কতখানি আর কতখানিই বা রয়েছে তার নেতৃত্বের কারিশমা তার ওপর। আমার বিশ্বাস মান্না সেই তেজস্বী দৃঢ়চেতা নেতা নন যে তিনি ডাকবেন আর মানুষ নেমে যাবে! অন্যদিকে দেশে পরমতসহিষ্ণু গণতান্ত্রিক পরিবেশ কতটাই বা আছে এই প্রশ্ন রয়ে গেছে বলেই তাকে রসিকতার ছলে বলেছিলাম, যদি আপনি আন্নার মতো দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনশন বা মানববন্ধনে যান তাহলে কর্মসূচিখানি জোহরের নামাজ শেষে শুরু করবেন আসরের আজানের আগেই শেষ করবেন। সন্ধ্যা গড়াবেন না। চশমায় টোকা দিয়ে মান্না কৌতূহল নিয়ে তাকালে আশপাশের বন্ধুরা হেসে দিলেন। আমি বললাম, দিনকাল যা পড়েছে বলা তো যায় না, তাই এই আইডিয়া দিলাম। মান্না পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে বীরের মতো বললেন, আমি তো রাত দেড়টা-দুইটায় বাড়ি ফিরি।
রসিকতার ছলে বললাম, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা জোরদার করুন। কে একজন বললেন, এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু নাকি চলাফেরায় দুই মাইক্রো নিরাপত্তা কর্মী রাখেন। আমি আরেকটু রসিকতা করে মান্নাকে বললাম, এক্ষেত্রে আপনি হিজড়াদের নিরাপত্তারক্ষী রাখতে পারেন। সবাই হাসি শুরু করলে বললাম, আমার অ্যাপার্টমেন্টে একবার চার তলার বাসিন্দার নবজাতক শিশুর কাপড়-চোপড় দেখে হিজড়ারা হানা দিয়েছিল। সিকিউরিটির লোকজন ভয়ে গেট খুলে দিয়েছে। তারা এসে আমার বাড়ির দরজায় লাথি, চেঁচামেচি শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে র্যাব-পুলিশকে কল করে আনা হলে দেখলাম হিজড়াদের অঙ্গভঙ্গি আর মুখের ভাষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মীরা তিন সিঁড়ি নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। এটা শুনে এফবিসিসিআইর আরেক সাবেক সভাপতি টিভি উপস্থাপনায় একদিন বালিকা হৃদয় জয় করা আনিসুল হক বললেন, তার কারখানায় হিজড়ারা গেলে কর্মচারীরা ঠেকাতে যায়নি। উল্টো ২৮ হাজার টাকা তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। মান্না অনেক মানবিক মনে হিজড়াদের প্রতি তার দুর্বলতা প্রকাশ করলেন, বললেন এদের নিয়ে একটি সেমিনার করতে হবে। জাহেদা খান চৌধুরী নামের এক মহিলা একবার হিজড়াদের নিয়ে একটি হৃদয় স্পর্শ লেখা পাঠালে আমরা ছাপিয়ে ছিলাম।
যাক, মাহমুদুর রহমান মান্নার ছাত্রজীবনের রাজনীতির সঙ্গে আমি কখনোই একমত নই। কিন্তু তার মেধা, সৃজনশীলতা, সততা, বাগ্মিতাকে দারুণ সম্মান করি। একজন পড়াশোনা জানা আধুনিক মানুষ হিসেবে তাকে আমি ভালোবাসি, তার সংগঠনের শক্তির সঙ্গে নিজের কারিশমা বা ইমেজের পাল্লা ভারী করেই চাকসু বিজয় করে এসে তিনি দুই দফা ডাকসু বিজয় করেছিলেন। ভিন্ন মতাবলম্বী হলেও তিনি ছাত্রনেতা হিসেবে যতবার সুনামগঞ্জ যেতেন আমি গিয়ে দেখা করতাম। মান্না তখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ২০০২ সালের কোনো এক দুপুরে আমরা যাচ্ছি পাবনা-রাজশাহীতে একটি নতুন ধারার দৈনিকের আত্মপ্রকাশ-পূর্ব সুধী সমাবেশে। যমুনা পার হয়ে তখন নবনির্মিত সুন্দর রেস্টুরেন্টটিতে খাবার অর্ডার দিয়ে যখন বসেছি তখন স্বেতশুভ্র পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত মান্না উঠে এলেন। তিনি যাচ্ছেন বগুড়া- তার নির্বাচনী এলাকায়। মান্নাকে আড্ডায় বললাম, বাড়ি বগুড়া, করতেন বিপ্লবের রাজনীতি, ছাড়লেনই যখন ধানের শীষ নিলে মন্ত্রীও হতেন, নেতাও হতেন। তার চেয়ে আপনি লেখালেখি করেন, রাজনীতি ছেড়ে দেন। আহমদ ছফার মতো চিন্তাশীল লেখকের বড়ই আকাল। দলবাজ লেখকদের ওপর পাঠকের কোনো আস্থা নেই। বিজ্ঞের মতো মান্না বললেন, দেশে আছেই রাজনীতি, তাই রাজনীতিটাই করছি। আর আওয়ামী লীগে আর যাই হোক গণতন্ত্র আর মুক্তিযুদ্ধখানি রয়েছে। এখানে আমি আমার কথা বলতে পারি, নেত্রীও যথেষ্ট সম্মান দিয়ে আমার কথার গুরুত্ব দেন।
ওয়ান-ইলেভেনের পর মান্না দলীয় মনোনয়ন পাননি, দলীয় পদ এমনকি পরবর্তীতে টিভি টকশো সঞ্চালকের জায়গাটিও হারিয়েছেন। সব হারিয়ে মান্না নাগরিক ঐক্য করে ড. কামাল হোসেনকে সামনে নিয়ে হাঁটছেন। মান্নার মধ্যে এখনো জাসদীয় রাজনীতির রোমান্টিক মন রয়েছে আমি বুঝতে পারি। অনুমান সত্য নাও হতে পারে। আমাকে যদি বলা হয় তুমি কাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বেশি আনন্দ পাও, আমি নিঃসন্দেহে যাদের নাম উচ্চারণ করব তাদের ক্রমতালিকায় রয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম, কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি, আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার, মাহমুদুর রহমান মান্না, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও আনিসুল হকের সঙ্গে। আরও অনেকেই আছেন যাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে নির্মল আনন্দ পাওয়া যায়। প্রাণ খুলে হাসা যায়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর আড্ডা নেশার মতো টানে। রোজ শুক্রবার তার সঙ্গে আড্ডা দিই। আমাকে যদি বলা হয় তোমাকে রাজনীতি করতে দিলে কার সঙ্গে করবে, দ্বিধাহীন চিত্তে বলব আমির হোসেন আমুর সঙ্গে। কারণ তিনি কর্মীকে ফেলে দেন না। কর্মীর জন্য লড়েন। আড্ডার চেয়ে কোনো আনন্দ পৃথিবীতে আর নেই। জামালপুরের তৃণমূল আওয়ামী লীগ কর্মী নূর মোহাম্মদ ও খন্দকার কামরুল হক শামীমের সঙ্গে নঈম নিজাম আর আমি কেন আড্ডার আনন্দ পাই সেটি বলা যাবে না। কিন্তু আনন্দ পাই দারুণ।
৫১ বছরের জীবনে পেছন ফিরে তাকালে কৈশোর, তারুণ্য, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এমনকি পেশার তারে জড়ানো জীবনের আড্ডায় কত বিষয় যে উঠে এসেছে তা লিখতে গেলে আরব্য রজনী পাঠে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। কী নেই তাতে? যাক, কথা বললেই বাড়ে কথা। মান্নার রাজনৈতিক পরিণতি বাংলাদেশের মানুষ জেনে গেছেন অনেক আগেই। মান্না যমুনার ওপারে যা বলেছিলেন এপারে এসে তার হিসাব মেলাতে পারেননি। আমাদের আড্ডায় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থেকে উঠে আসা কথার পেছনে কোনো হিসাবও ছিল না। ড. কামাল হোসেনের মতো মানুষেরা আওয়ামী লীগে থাকতে পারেননি। মোস্তফা মহসিন মন্টুর মতো সাহসী বঙ্গবন্ধু কর্মীরা দলটি করতে পারেননি। গণফোরামে হিজরত করে আসা অনেকেই আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হয়েছেন। জিয়ার খাল কেটে ক্লান্ত হওয়া বামরা আওয়ামী লীগে নেতা-মন্ত্রী হয়েছেন। খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করে সরকারকে বিতর্কে ফেলা লোকরাও প্রভাবশালী থেকে যান। এসব কোনো হিসাবে মেলে না। নিজের খেয়ে পরে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মতো মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা আওয়ামী লীগে প্রাপ্য সম্মান পান না। মোজাফফর হোসেন পল্টুদের জায়গা হয় না। সুলতান মনসুরের মতো ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ডাকসুর মুকুট মাথায় নিয়েও দলে ঠাঁই পান না। মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো নেতা যিনি ছাত্রসমাজের নয়নের মণি হয়ে দুজন সেনাশাসকের মন্ত্রিত্বের লোভ ত্যাগ করে পথ হেঁটে বিএনপির রাজনীতিতে না গিয়ে আওয়ামী লীগে এসেও কেন থাকতে পারলেন না সে উত্তর তার নিজের কাছে থাকুক বা না থাকুক আমাদের কাছে নেই। জাতীয় রাজনীতিতে যারা মানুষের আগ্রহ কুড়ান, সম্মান পান তাদের কারও কারও গোপন বিলাসী, বহুগামী চরিত্র দেখলে বোঝা যায় তারা কেন তাদের নেত্রীদের করুণাশ্রিত জীবনকেই বেছে নিলেন। জগৎ বিখ্যাত নেতারা প্রেমিক হন।
নেহেরু-ম্যান্ডেলা ছিলেন। দলের মেয়েদের নিয়ে বিদেশের হোটেলে রাতযাপন আর শাড়ি উপহার দিয়ে ভোগের জীবনযাপন করেন তাদের দিয়ে গণমানুষের রাজনীতি হয় না। বৈধ আয় দেখা যায় না, নিষ্কলুষ চরিত্র দেখা যায় না, বিলাসী জীবন, কর্মীর কাছে কমিশন, তদবিরবাজি, দালালি, অনৈতিক অর্থের মোহ, ক্ষমতার লোভ, ত্যাগবাদী কমিটমেন্টের অভাব, মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ বিদ্যমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে গণমানুষের আশা পূরণ হয় না। এরা সমালোচনাও সইতে পারেন না। গরিবের বন্ধু নন, বিত্তশালীদের দালাল, কর্মীবান্ধব নন, ক্ষমতাবান্ধব- এদের চেয়ে মানুষের কাছে দুই নেত্রী উত্তম। তাদের করুণায় এসব নেতা পতাকা উড়িয়ে বড়র মতো হাঁটেন। বড় হতে পারেন না। পরিবর্তন বা বিপ্লব যারা করেন তাদের একটি বয়স থাকে। সেই বয়স আজকের রাজনৈতিক নেতাদের নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে তারুণ্যের তেজদীপ্ত নেতৃত্ব তৈরির পথ রুদ্ধ। তাই কখনো ঝড় উঠলে তরুণরাই তুলবে। মানুষ নামবে।
৩. ডাকসু ভিপি আখতারুজ্জামান কোথায় কেমন আছেন জানতে চাইলে যে কেউ বলবেন একটি জেলার রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে আছেন। কিন্তু ভালো কি আছেন, সেই উত্তর আমাদের কাছে নেই। আওয়ামী লীগ নামের দলটি ইদানীং বেশ নড়েচড়ে উঠেছে। সংগঠন গোছাচ্ছে। আওয়ামী লীগসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন জেলায় জেলায় সম্মেলন করছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় আজকের আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কতটা মেধানির্ভর? কতটা প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ? পোড়খাওয়া সংগঠকনির্ভর? মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতাদের সমারোহ কতখানি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর কেউ দেওয়া দূরে থাক ভাবছেন কিনা সেটিও বিষয়। রাষ্ট্র পরিচালনার মতো কঠিন এবং রাজনীতির মতো দুর্বোধ্য বিষয় মোকাবিলা করেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক ছোটখাটো বিষয়ের সমস্যা সমাধানেও যখন ভূমিকা রাখতে দেখা যায় তখন নেতৃত্বের সংকট উন্মোচিত হয়। দেশে দলীয়করণের প্রতিযোগিতা প্রশাসনের ওপর মানুষের আস্থা ও সম্মানের জায়গা সরিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ নির্বাচন নেই। ছাত্ররাজনীতি মেধাবী সৃজনশীল ছাত্রদের কাছ থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে ছাত্রসমাজের আস্থা হারিয়েছে। নিয়োগবাণিজ্য বা রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ স্বীকৃত হয়েছে। দুর্নীতি দিনে দিনে বহু বেড়েছে। রাজনীতিতে সহনশীলতার উল্টো পথে আগ্রাসী রূপ নিয়েছে প্রতিহিংসা। গুম, খুন মানুষের জীবনকে নিরাপত্তাহীন করেছে।
ইয়াবাসহ মাদকের আগ্রাসন একেকটি পরিবারকেই নয়, দেশের একটি প্রজন্মকে অন্ধকার পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সম্পদ সীমিত, জনসংখ্যা বাড়ছে। শিল্প, কল-কারখানা থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগকারীরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, কর্মসংস্থানের খবর নেই। উন্নয়ন চলছে, দুর্নীতি থেমে নেই। রাজনীতিতে ত্যাগবাদী আদর্শের উল্টো পথে উন্নাসিক রূপ নিয়েছে ভোগ-বিলাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তদবির বাণিজ্য সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। মানুষের লোভ-লালসা এতটাই তীব্র যে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে বাজিকরদের আস্ফালন চলছে। গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন যেমন চলছে তেমনি আন্দোলনের নামে দেখা দেয় মানুষ হত্যা আর জানমালের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা। সাংবিধানিকভাবে জনগণ ক্ষমতার মালিক হলেও রাজনৈতিক শক্তির কাছে মানুষের অধিকার ও সম্মানবোধ দিনে দিনে পদদলিত হচ্ছে। বিমানের মতো সংস্থা লোকসানের পাল্লা গুনতে গুনতে আকাশে উড়ে। শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে ধরা পড়ছেন।
একেকজন ব্যক্তির কাছে এক একটি প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হতে হতে ক্ষয়ে যাচ্ছে। বিমান তেমনই একটি। বিমান ডুবছে ডুবুক, মান্না হাঁটছেন হাঁটুন, মাদক সাম্রাজ্যে তলিয়ে যাক যুবসমাজ, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস অস্থিরতা চরম আকার নিক। দুর্নীতিবাজরা সমাজে সমাদৃত হোক। দলকানারা যে পেশারই হোন নির্লজ্জতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন কোনো অসুবিধা নেই। পরিস্থিতি যেমন এমনই গা সওয়া হয়ে গেছে। সব কিছু দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। সব কিছু ভাবলে মন অস্থির হয়ে ওঠে। বুকের ভেতরে কবি নজরুল বিদ্রোহ করে। নজরুলের ভাষায় মাঝে-মধ্যে বলতে ইচ্ছে করে 'অমর কাব্য লিখিও বন্ধু তোমরা যারা আছ সুখে/ দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি তাই যাহা আসে মুখে তাহাই কহি'। কখনো সখনো বিষণ্ন মন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় গাইতে ইচ্ছা করে 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে...'। অনেকেই বলেন এত বলতে হবে না, এত লিখতে হবে না। এত দায় নিজের কাঁধে কেন নিতে হয়? আমি বলি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'সত্য সে যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম আমি/কারণ সত্য কখনো করে না বঞ্চনা'। মাঝে-মধ্যে নিশুতি রাতে ইনসমনিয়ায় ভুগতে ভুগতে চারপাশের কথা ভাবলে আমার ভেতরের বাউল মন ডুকরে কেঁদে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর মতো একখানি অঙ্গুলি হেলনের নেতা নেই।
তর্জনী উঁচু করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অমিত সাহসী কোনো ভাষা নেই। রাজনীতিতে মওলানা ভাসানীর 'খামোশ' শব্দ থেকে উঠে আসেননি কেউ। রবীন্দ্রনাথকে ফের মনে পড়ে যায়। যেন 'মহাকাব্যের যুগ অতীত হইয়া গিয়াছে'। ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আমার তখন প্রকৃতির কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় মান্নাকে বলি আপনি হাঁটুন, আমি বুনোর আঁচল ধরে জলজোছনার হাওরে ভরা পূর্ণিমার রাতে বজরায় ভাসি। জোছনা স্নান করি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভাসতে ভাসতে জোছনার আলোয় তার চোখ-মুখের খেলা দেখে মুগ্ধ হই। আমার হৃদয় মন এখান থেকে বেরিয়ে চাঁদের আলোয় এক ঐশ্বরিক রোমান্টিক মুগ্ধতায় ভরে উঠুক। বুনোর হাত ধরে চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে শুনি 'আহারে সোনালী বন্ধু শুনিয়া যাও মোর কথারে, হাসন রাজার হৃদকমলে তোমার চান্দমুখ গাথারে'। এখানেও কেউ প্রশ্ন তুলবেন বুনো আবার কে? কেন! সুনীলের কবিতায় বার বার ফিরে আসা নীরা। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার লাবণ্য কিংবা পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথনের নায়িকা নন্দিনী অথবা হতে পারে কৈশোরে পাঠ নেওয়া দস্যু বনহুরের নুরী, হতে পারে মাসুদ রানার কাছে টানে বাঁধনে জড়ায় না সোহানা, এমনকি সে হতে পারে সুনীলের 'ছবির দেশে কবিতার দেশে'র নায়িকা মার্গারিট জয়ের কবিতার অরুনিমা। নিদেনপক্ষে আমার এক সময়ের কলামে উঠে আসা মন্দিরা। দেশের পরিস্থিতিটাও এমন- প্রশ্ন অনেক, উত্তর মেলে না কোনোটার। তাই বলতে ইচ্ছা করে যা চলছে সব চলুক। যারা গ্রহণ করার গ্রহণ করুন। সয়ে যাওয়ার সয়ে যান।
এড়িয়ে যাওয়ার এড়িয়ে যান। আমার কোনোটারই যেন সামর্থ্য নেই। তাই বলছি বিমান ডুবুক, মান্না হাঁটুন, আমি বুনোকে নিয়ে জলজোছনার হাওরে যাচ্ছি।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৪