“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর/বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি/অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী/নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা করে নারী হেয়জ্ঞান?/তারে বলো, আদি-পাপনারী নহে, সে যে নর-শয়তান/এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল/নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল/জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য লক্ষ্মী নারী/সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি/পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ/কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি,সমীরণ, বারিবাহ-এভাবেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারীর মূল্যায়ন করেছেন তার কালজয়ী কবিতায়। এই কবিতার মর্মার্ত যদি সবাই বুঝতো অনেক বদলে যেতো সমাজের চিত্র।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকায় নারীদের এক সম্মেলনে ২৫ নভেম্বর ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে এই দিবসটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। জাতিসংঘ দিবসটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস’ উদযাপন কমিটি ১৯৯৭ সাল থেকে ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ পালন করছে। নারী নির্যাতন বন্ধে সচেতনতা বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই সঙ্গে দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে আগামী ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ-২০১৪ পালন করা হবে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য এলিমিনেশন অব ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন’ বা আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস ২০১৪ থেকে ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ শুরু হলো। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে বিশ্বের যে কোন প্রান্ত চোখের সামনে যেন দেখতে পাই। আচ্ছা, আমরা কি এই পনেরোদিন বা এক পক্ষ আমাদের চারপাশের নারীদের প্রতি একটু বেশী দায়িত্বশীল হতে পারি? এর মাধ্যমে শুরু হোক্ নতুন আলোর দিনের প্রত্যাশার জয় ছিনিয়ে আনার পথে চলা!! নিরাপদ সমাজ গড়তে এই পথের কোন বিকল্প নেই।
‘নারী’ শব্দটি কি নির্যাতন ও শোষণের প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে? জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে সমাজ কাঠামো,বিকশিত হচ্ছে সভ্যতা। পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে মানুষের জীবন যাত্রায়। উইকিপিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য মতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা অনুপাতে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল,শ্রীলংকা, ইরানের নাম আছে ধারাবাহিকভাবে বিশ্বপরিসংখ্যানের প্রথম সারিতে। এরমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশের ৯৫% পরিবার তাদের কন্যার বিয়েতে যৌতুক দিতে বাধ্য হন। যৌতুক দিলেও নারীরা নানান অজুহাতে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে উইকিপিডিয়াতে। পাকিস্তানের পরেই নারী নির্যাতনের দেশ হিসাবে উইকিপিযিয়াতে উঠে এসেছে বাংলাাদেশের নাম। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৪শ’৭জন নারী যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে বলে প্রকাশ করেছে উইকিপিডিয়া।
‘জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষ জন্মগতভাবে সমান মর্যাদার অধিকারী’ এই বাণীর মাধ্যমে ১৯৪৫ সালে বিশ্বের সকল মানুষের মানবাধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে শান্তি ও প্রগতি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের জন্ম। বাস্তবে সমান মর্যাদায় সকল মানুষকে গুণতে ব্যর্থ হলো জাতিসংঘ। পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে জিম্মি এ সমাজে দেশে দেশে নারী চরমভাবে অবহেলিত। যা জাতিসংঘের মূললক্ষ্যকে পুরোপুরি ব্যাহত করেছে। সেই চরম সংকট থেকে উত্তরণে ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে Convention on Elimination of all forms of Discrimination Against women সংক্ষেপে CEDAW (সিডও) বা ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ’ নামে একটি সনদ গৃহীত হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার সম্পর্কিত সনদসমূহের অন্যতম ‘সিডও’। নারীর প্রতি অন্যায় এবং অবিবেচনামূলক বৈষম্য দূর করার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার ফসল ‘সিডও’ সনদ। ‘নারীর মানবাধিকার দলিল’। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৃহীত সিডও সনদ ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্বব্যাপী কার্যকর হতে শুরু হয়। ১৯৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষর করে। এই স্বাক্ষরের মাধ্যমে ‘সিডও’ সনদের সাথে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেছে বাংলাদেশ। একই সাথে নিজ দেশে তা বাস্তবায়নে অঙ্গিকরাবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই দলিলে স্বাক্ষরের ২৮ বছর পরও সিডও সনদের গুরুত্বপূর্ণ ধারাসমূহ বাংলাদেশে বাস্তবায়ন হয়নি।
১৯৯৭ সালে প্রথম এশিয়ান নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশের সালমা খান ‘সিডও’ এর চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৬ সালে ফেরদৌস আরা বেগম ১৮৫টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ১৪০টি দেশের সমর্থন পেয়ে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট ‘সিডও’ কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ইসমত জাহান দু‘বছর আগে ‘সিডও’ এর সদস্য নির্বাচিত হয়ে যথারীতি দায়িত্ব পালন করে চলেছেন, যা বাংলাদেশের জন্য অনেক গর্বের বিষয়। ‘সিডও’ সনদের মূল বক্তব্য উন্নয়ন কর্মকন্ডে নারী যুগ যুগ ধরে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে তার যথাযথ স্বীকৃতি দানে সমাজকে দায়িত্বশীল হতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা বিধানের গুরুত্ব উপস্থাপন করা এবং নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দানই হচ্ছে এই সনদের উদ্দেশ্য। বিশ্বব্যাপী নারীর অবস্থান এখনও প্রান্তিক পর্যায়ে এবং বাংলাদেশের অনেক নারী মানসিক এবং শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়ে দুর্বিনীত কাল অতিক্রম করে কখনো হত্যা, কখনো স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেয়। আবার কখনোবা কষ্ট সইতে সইতে নীলকন্ঠ হয়ে নীরবে তিল তিল মৃত্যুর দ্বারে পৌঁেছ যায়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে,এতোদিন ধরে অনেক ভোটে ‘সিডও’-তে বাংলাদেশের নিয়মিত প্রতিনিধিত্ব ার্জিত হলেও এখনো কেন সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন হচ্ছেনা?
পরিসংখ্যান বলে,পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী হলেও পৃথিবীর মোট আয়ের মাত্র ১০ শতাংশ নারীর জন্য ব্যয় হয় এবং পৃথিবীর সকল সম্পত্তির শতকরা দুই ভাগেরও কম সম্পত্তিতে নারী অংশীদার। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে এ বৈষম্য আরও ভয়াবহ। আর তাই যে কোন দেশের জন্যেই ‘সিডও’ সনদদের পূর্ণ বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৪ সালের রাষ্ট্রীয় গবেষণা তথ্য মতে বিশ্বে এখনো প্রতি ১০০ জন কন্যাশিশুর বিপরীতে ১০৭ জন ছেলে শিশু জন্ম নিচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি ১হাজার ছেলে শিশুর সমান্তরালে ৯শ’৩৪ জন কন্যাশিশু। মার্কিন পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখনো পুরুষের সংখ্যা কিছুটা বেশি। যদিও অনেক সময় বলা হয়,বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। তবু এখনো জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি নানান ভাবে প্রতিহিংসা আর বৈষম্যের শিকার হয়ে অকালে মৃত্যু বরণ করে বিশ্বের নানান প্রান্তে অসংখ্য নারী। সমাজের উন্নয়নে নারীর বিন্দু বিন্দু ঘাম, মেধা, শ্রম নিবেদিত হলেও বিংশ শতাব্দী পেরিয়েও শান্তি, নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করে নারীর স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি বিশ্বের কোন সমাজ।
২০১৩ থেকে ২০১৪ এক বছরে বাংলাদেশে সাড়ে ৫হাজারের বেশি নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তৈরি করা পরিসংখ্যানমতে,নির্যাতিত নারীদের মাত্র ২% আইনের আশ্রয় নেন। লোকলজ্জার ভয় এবং অন্তর্মুখীনতার কারণে অনেক নারী তার নির্যাতনের কথা লুকিয়ে রাখে। সেসব না বলা কথা কেউ জানতেও পারেনা। সেসব যদি উঠে আসতো, প্রকৃত পরিসংখ্যানের চিত্র হয়তো শিউরে উঠার মতোই ভয়াবহ হতো।
২০০৮ সালে যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২শ’৬৯টি। ২০১২ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৭শ’৭১ টি। অর্থাৎ ২০০৮ থেকে ২০১২ সালে নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ধর্ষণের হার বেড়েছে ১৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নযয়ন অন্বেষণ’-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যান উঠে এসেছে।
‘‘যৌন হয়রানি, নিপীড়ন ও সকল প্রকার সহিংসতা মুক্ত শিক্ষাঙ্গণ চাই’’এই শ্লোগানকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দীকী বলেছেন, একবিংশ শতাব্দির এই সময়ে যদি শুধু মাত্র নারী হওয়ার কারণে নির্যাতনের শিকার হতে হয় তা সত্যিই আমাদের জন্য বেদনাদায়ক এবং উদ্বেগের বিষয়। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত প্রায় অর্ধেক। নারীর এই অগ্রযাত্রা সেদিক থেকে অনেক প্রশংসনীয়। কিন্তু পাশাপাশি নারীর প্রতি যে সহিংসতা, যৌন হয়রানী, নিপীড়ন এগুলো আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। তাই শিক্ষকগণ থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্থান থেকে নারী নির্যাতন প্রতিহত করতে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। ”এই বক্তব্য সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ যদি অনুধাবন করতো, এই সমাজ বদলে অনেক নারীবান্ধব হয়ে যেতো। অনেক নারী এবং পুরুষ এখনো তাদের দায়িত্ব পালনে সচেতন নন। যাদের চরম দায়িত্বহীনতা এবং অন্যায়ের কারণে চরম বৈষম্য এবং নিপীড়নমূলক সমাজের এই ভয়াবহতা এখনো বিরাজমান।
তবু আমরা স্বপ্ন দেখি,এই সমাজ একদিন নারী-বান্ধব হবে। আর নারী নির্যাতনের চিত্র দেখে হা-হুতাশ নয়; হৃদয়ে আর রক্তক্ষরণ নয় !!
নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য এবং নির্যাতন প্রতিরোধে সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আর কথার ফুলঝুরি নয়, বন্ধু, ভাই সহকর্মীরা আসুন নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ-২০১৪ পালনে আমরা একাত্ম হই। লেখার শুরুতে যে আহ্বান জানিয়েছি, সমাজ বিনির্মানে পরিশেষে সেই উদাত্ত আহ্বান জানাই সকল বন্ধু, ভাই , স্বজনদের।
বাংলাদেশ সময়: ০৬২১ ঘন্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৪