শীতের কথা মনে হলেই অন্তরাত্মায় কিছু লোভনীয় দৃশ্য নিত্য দোল খেতে শুরু করে। আহা! সেই শীতকালকে ঘিরে কত উৎসব! রঙিন ছেলেবেলার পরতে পরতে শীত নিয়ে কত স্মৃতি! তা কি ভোলা যায়?
আমাদের বাংলাদেশের গ্রাম বাংলায় শীত আসে চুপি চুপি অনেকটা ধীর পায়ে।
![](files/December_2014/December_27/Hf_inner1_banglanews24_847070749.jpg)
কথায়, চলনে, বলনে, আচরণে গার্হস্থ জীবনের সব কাজের পাশাপাশি তার হাতদুটো থাকতো সদা চঞ্চল, আঙুলগুলো হয়ে উঠতো ক্ষিপ্রতার প্রতীক। স্পষ্ট দেখতে পেতাম কিছুদিনের মধ্যেই কত দক্ষতা আর শৈল্পিকতাকে নিয়ে তার ধূসর রং এর ওলের কাঁটা থেকে সোয়েটার বা মাফলারগুলো কত আদর আর ভালোবাসায় জড়াজড়ি করে আমাদের গাযে উঠে আসতো! এই স্মৃতি ভুলি কেমন করে? সত্যি, আমাদের দেশে শীত কতই না সুন্দর আর শৈল্পিক হয়ে আমাদের দরজায় টোকা দিতো?
শীত মানেই ছিলো পিঠার মহাউৎসব। পিঠা তৈরির জন্যে আলাদা করে চাল দাদির বাড়ি থেকে আগে থেকেই পাঠিয়ে দেওয়া হতো। আম্মা সেই চাল কৃপণের মত জমিয়ে রাখতেন আমাদের পিঠা খাওয়াবেন বলে। কত রকমের শীতের পিঠা! বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে সবখানে তখন পিঠার উৎসব। পিঠার নাম অঞ্চলভেদে একেক রকম। নাম দিয়ে কাজ কি? উৎসবের রঙতো সবখানেই সমান! বাড়িতে মেহমান এলে পিঠাই ছিল সবচেয়ে ভালো আপ্যায়ন। শীতকালে পিঠা খাবনা তাও কি হয়!
![](files/December_2014/December_27/Hf_inner_2_banglanews24_955378636.jpg)
স্পষ্ট মনে আছে আম্মা শীতের সময় খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ভাঁপা পিঠা বানাতেন। আমরা ভাইবোনরা তখন আম্মাকে ঘিরে বসে পড়তাম। ঢাকনা দেওয়া একটা বড় রুপালি রং এর হাড়ির মুখ কাপড় দিয়ে বাধা। সেই কাপড়ে ভাপের তাপে পিঠা হচ্ছে। সাদা গোলাকার ভাঁপা পিঠার মাঝ খানে থাকতো খেজুরের গুড়। গরম গরম পিঠা হওয়ার সাথে সাথেই আব্বার ডাক পড়তো। তারপর আমাদের সবার মিলিত আনন্দে চলতো পিঠাযজ্ঞ উৎসব।
শীতের রাতে কেউ কি কখনো খেজুরের রস খেয়েছেন? মনে আছে সেই স্মৃতি? আমাদের গ্রামের বাড়িতে টুনু চাচার অনেকগুলো খেজুর গাছ ছিল। দিনের বেলায় সেই খেজুর গাছ থেকে টপ টপ করে মাটিতে রস পড়তো। আমরা তখন আকাশের দিকে হা করে সেই রস আশ্বাদনের চেষ্টা করতাম। কখনো রসের ফোটা জিহ্বার ডগায় পড়তো, কখনো কখনো তা ভুল করে কপালেও পড়তো। আহা! কিযে সেই আনন্দ! তা কি মুখে প্রকাশ করা যায়? তবে একটা ঘটনার কথা খুব বেশি মনে আছে। গভীর রাত। গ্রামের কয়েকজন অতি উৎসাহী যুবক তখন আমাদের বাড়ির পেছনেই আমার অপেক্ষায়। আমি তখন ঘুমের অভিনয় করে শুয়ে আছি। দেখতে দেখতে বাড়ির সব আলো নিবে গেল।
![](files/December_2014/December_27/HF_inenr_3_banglanews24_480310739.jpg)
তখন আমি লেপের নিচ থেকে মাথাটা বের করে মায়ের সদ্য বোনা সোয়েটার গায়ে চড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে বের হয়ে গেলাম। বাইরে এসেই দেখি আমার অপেক্ষায় টিপু, সরাফত, ফারুকসহ আরো কয়েকজন। তারপর সবাই গেলাম সেই পুকুরপাড়ে খেজুর গাছের নিচে। শীতের রাতে কুয়াশার চাঁদরে খেজুর গাছগুলোকে দেখলে তখন মনে হতো কোনো ভৌতিক রাক্ষষ-ক্ষোক্কস জাতীয় কোনো কিছু। চোখের পলকেই টিপু, সরাফত এরা সবাই গাছগুলোতে উঠে রসের কলসগুলো একে একে নামিয়ে আনল। তারপর শুরু হল সেই কলস থেকে মধু আহরণ। কি ঠাণ্ডা সেই রস! আর কি অসম্ভব ছিল তার স্বাদ! ভুলি কেমন করে?
![](files/December_2014/December_27/Hf_inner_5_banglanews24_859633515.jpg)
শীত কালের কুয়াশার কথা কি এত সহজেই ভোলা যায়? খুব ভোরে চেনা রাস্তার অলিগলিগুলো সাদা কুয়াশায় ঢেকে যেত। তখন পরিচিত মানুষটাকেও কত অপরিচিত মনে হত! কণ্ঠ শুনে আমরা তখন ব্যক্তিটির পরিচয় জানতে পারতাম। তবে সবচেয়ে সুন্দর লাগতো যখন নদীর বুকে কুয়াশা নামতো সেই দৃশ্য দেখে। দূরে মাছ ধরার ছোট ছোট নৌকাগুলোর হারিকেনের বাতি মিট মিট করে জ্বলতে দেখা যেতো। কুয়াশার রঙ এর সাথে সেই হারিকেনের বাতিরে রঙ মিশে কেমন যেন একটা রঙ তৈরি হতো। সেই সাথে মাঝিদের হালকা হাকডাক। নদীর পানির উপর যখন কুয়াশাগুলো ভেসে বেড়াতো তখন মনে হতো কি যেন এক অশরীরী আত্মা পানির উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে এক আসাধারণ দৃশ্য। বাংলার সেই শীত কি এখনো আছে? খুব জানতে ইচ্ছে করে?
লেখক: প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৪