ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসেও সাংবাদিকের অস্থি-সন্ধিতে ক্ষতচিহ্ন

রাশেদ মেহেদী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০০ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১৫
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসেও সাংবাদিকের অস্থি-সন্ধিতে ক্ষতচিহ্ন ছবি: প্রতীকী

সাংবাদিক অমিতোষ পালের ফুলে যাওয়া চোয়াল এখনও সেরে ওঠেনি। সুজয় মহাজন ব্যথায় এখনও সোজা হয়ে হাঁটতে পারছেন না।

লিখতে বসলেই পরিমল পালমার এখনও মাথা ঘোরে। গুলিবিদ্ধ ইয়াসিন হাসান রাব্বীকে হয়ত সারাটা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে গুলির ক্ষতচিহ্ন। ২৮ এপ্রিল তিন সিটি নির্বাচনে নির্যাতনের শিকার ২৪ জন সহকর্মী সাংবাদিক এখনও সুস্থ হননি। শরীরের অস্থি-সন্ধিতে পাঁচ দিন আগের নির্যাতনের দগদগে ক্ষত নিয়েই আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছেন বাংলাদেশের সাংবাদিকরা।

একটা কথা বেশ প্রচলিত হয়ে গেছে, ‘সাংবাদিক পেটালে এখন আর কিছু হয় না’। আগেও সাংবাদিক নির্যাতন হয়েছে। কিন্তু তখন সাংবাদিক সংগঠনগুলো নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সরব হয়ে উঠত। আর কিছু না হোক, নির্যাতনকারীরা লজ্জায় মাথা নুইয়ে জোড়হাত করতেন। গত পাঁচ-সাত বছরে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। এখন সাংবাদিক নির্যাতন করার পর সগর্বে সেই গল্প চলে চলতি পথে, আড্ডায়, চায়ের টেবিলে।

নির্বাচনের এক দিন পর ৩০ এপ্রিল একটি বাসে খিলক্ষেত থেকে তেজগাঁও যাচ্ছি। আমার আসন থেকে একটু পেছনে দাঁড়িয়ে দুই তরুণ গল্প করছে। আলাপে বোঝা গেল তারা কলেজছাত্র। আলাপ ছিল এ রকম, ‘দোস্ত, ডান হাতের আঙুল দুইটার ব্যথা যাইতেছে না, কি করি ক’ত?’

আর এক দোস্ত বলছে, ‘তুই শালা মানুষ হইলি না, মাইর খাইলে একটা কথা ছিল, আর একজনরে মারতে গিয়া নিজের হাত ফাটাই ফালাইছস!’ আগের ছেলেটি বলছে, ‘আমার আঙুলের এই অবস্থা, ওই শালা সাংবাদিকের অবস্থা বুঝতে পারছস! এমন মাইর দিছি, হাড্ডি এক্কেবারে ফাটাই ফালাইছি। জীবনে আর মোবাইল দিয়া ছবি তোলার নাম নিব না। ’ ‘যে ছবিগুলা তুলছিল, ওগুলো কি ওই হালার কাছে রয়া গেছে?’

‘আরে না, শালারে মাইর দিলাম তো ওই কারণেই। অরে কইলাম, ছবি তুলছেন, ভাল কথা ক্যামেরা দ্যান, ছবি মুইছ্যা দিমু, ভোটকেন্দ্র ছাইড়্যা ভাগতে হইব। শালা কয় কি, ছবি মোছা যাইব না। আর কোনো কথা নাই, শুরু হইল মাইর। আর পুলিশ শালার মোবাইল নিয়া সব ছবি মুইছা দিছে, শালা আমার সিল মারার ফ্রন্টাল ছবি তুইল্যা ফেলছিল। ’

পাশ থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোক ওই তরুণদের বললেন, ‘আস্তে কথা বলো। এত জোরে কথা বললে অন্য লোকের সমস্যা হয়, এটা বোঝ না?’
এক তরুণ জবাব দিল, ‘সমস্যা হইলে আপনি বাস থিকা নাইম্যা যান। মুরুব্বিগিরি দেখাবেন না। ’ এই তরুণরাই আগামী দিনের সূর্যসন্তান!

২৮ এপ্রিল সাংবাদিক নির্যাতন করেছে মূলত ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের কর্মীরা। উৎসবমুখর পরিবেশে সাধারণ ভোটারদের ভোট দেওয়ার দায়িত্বটিও মূলত তারাই পালন করেছে। এ কারণে অনেক ভোটারকে আর কষ্ট করে ভোট দিতে হয়নি। আমি আমার এলাকার কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটিও দিতে পারিনি।

সাংবাদিকদের ক্যামেরায় ছবিও উঠেছিল ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদেরই। সাংবাদিকদের উপর হামলাও করেছে তারাই। আর পুলিশ যতটা সম্ভব তাদের সহযোগিতা করেছে। এর আগে সন্ত্রাসের জনপদ লক্ষ্মীপুরেও সরেজমিনে নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করেছি। সেখানে অস্ত্রহাতে লুঙ্গিপরা সন্ত্রাসীদের ভোটকেন্দ্র দখল করে রাখতে দেখেছি। কিন্তু সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তারাও হামলা করার সাহস করেনি। বরং কিছুটা দূরে সরে গেছে।

নোয়াখালীতে দেখেছি, সাংবাদিকদের উপর ক্যাডাররা হামলা করতে উদ্যত হলে জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা ছুটে এসে তাদের বাধা দিয়েছেন।

কিন্তু ঢাকার প্যান্ট-শার্টপরা ভদ্র চেহারার গুন্ডারা লক্ষীপুরের লুঙ্গিপরা সন্ত্রাসীদের চেয়েও ভয়ংকর। এটা ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনে স্পষ্টই বোঝা গেছে। একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় ছিল, ২৮ এপ্রিল সাংবাদিক কার্ডগলায় দেখলেই কেন্দ্র দখলে রাখা ছাত্রলীগ-যুবলীগকর্মীরা তেড়ে এসেছে। হয়ত এমন নির্দেশ তাদের দেওয়া হয়েছিল। হয়ত সাংবাদিক নেতারাও পরিস্থিতির পূর্বাভাসই পেয়েছিলেন। এ কারণে  এবারের সিটি নির্বাচনে দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। অথচ সাংবাদিক সংগঠনগুলো দায়সারা নিন্দা জানানো ছাড়া তেমন কোনো  প্রতিবাদই করেনি। বিএফইউজে, ডিইউজের নেতারা সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদ না করে প্রায় নিশ্চুপ থেকেছেন! মার খেয়েছেন রিপোর্টাররা। ঢাকায় রিপোর্টারদের বড় সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি। অতীতে রিপোর্টার্স ইউনিটি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় সরব হয়েছে, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে তাদের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরও উচ্চকিত ছিল। কিন্তু এবার লক্ষণীয়ভাবে রিপোর্টার্স ইউনিটি নেতাদেরও কন্ঠ একেবারেই দুর্বল।
 
অর্থাৎ, এবারের মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে আমরা জেনে গেলাম, বাংলাদেশে মাঠে কাজ করা সাংবাদিকদের যখন যে খুশি মারবে, এই নিয়তি মেনে নিয়েই সাংবাদিকতার ‘চাকরি’ করতে হবে। এদেশে একজন মেডিক্যাল ইন্টার্নের উপর হামলা হলে সারাদেশে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি হামলাকারী পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হলেও তার চাকরি যাবার যোগাড় হয়। একজন আইনজীবীর উপর হামলা হলে কোর্টপাড়া বিক্ষোভে উত্তাল হয়।   একজন প্রকৌশলী বা  সরকারি কোনো কর্মকর্তা  হামলার শিকার হলে চতুর্দিকে শোরগোল–বিক্ষোভ কম হয় না। ব্যতিক্রম কেবল শুধু সাংবাদিক আর শিক্ষকদের বেলায়। তারা মার খেলে এমনকি হত্যার শিকার হলেও কিছুই হয় না। অর্থাৎ, এ দুই পেশাজীবীরা এখন পর্যন্ত পূর্ণ পেশাজীবীর মর্যাদা পাননি। পেশাজীবীর পরিচয়ে সাংবাদিক আর শিক্ষকরা নিছক সাধারণ চাকুরে কিংবা কর্মচারী! সাংবাদিক আর শিক্ষক নেতাদের দলকানা, স্বার্থান্ধ ও নতজানু নেতৃত্বই এ দুই পেশাজীবীদের অবস্থান, মর্যাদাকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করছে। নব্বই এর দশকে দৃঢ় সাংবাদিক নেতৃত্ব প্রবল পরাক্রমশালী স্বৈরাচারকেও তার অন্যায়ের জন্য সাংবাদিক সমাজের কাছে মাথানত করতে বাধ্য করেছে। আর আজকের নেতৃত্ব একজন সহকর্মীর নির্যাতনের বিচার চাইতেও কুন্ঠিত হয়। অতএব, সামনের দিনগুলোতে মাঠের রিপোর্টারদের আরও বেশি ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্বপালন করতে হবে, সন্দেহ নেই। রিপোর্টারদের বেশি প্রতিবাদী হওয়ারও সুযোগ নেই। কারণ অতি মূল্যবান চাকরিটা হারানোর ভয় রিপোর্টারদের মাথার উপরই বেশি।  

সাংবাদিক নির্যাতন কেন? অনেকেই বলেন, টেলিভিশন রিপোর্টাররা ইদানীং নাকি বেশ মস্তানি করে, বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। এর জন্য সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে বেশি। সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকে অসৎ সাংবাদিক আছেন, তাদের কারণে সংকট তৈরি হচ্ছে। এ অভিযোগ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্য।   কিন্তু ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনের দিন মার খেয়েছেন কিংবা লাঞ্ছিত হয়েছেন আমার দেখা সবচেয়ে ভদ্র ও নীতিবান সাংবাদিকরা। আশীষ উর রহমান শুভ, অমিতোষ পাল, মোশতাক আহমেদ, পরিমল পালমা কে যারা চেনেন, তারাই জানেন এই মানুষগুলো কতটা ভদ্র ও পেশাগতভাবে সৎ। কখনও কাউকে আঘাত করার মত কথা কিংবা অসংযত আচরণ তারা করেছেন, এমনটা কেউই বলতে পারবে না।   এরাই যখন হামলার শিকার হন তখন তো আর কোনো অভিযোগই ধোপে টেকে না। সাংবাদিক নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনার তদন্ত করে দেখুন, দুর্নীতিবাজ এবং অন্যায়ের সঙ্গে জড়িতরাই সাংবাদিকদের উপর হামলা চালিয়েছেন। ন্যায়পরায়ণ পেশাজীবী, সরকারি চাকুরে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য, ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী কারও সঙ্গেই সাংবাদিকদের বিরোধ হওয়ার রেকর্ড নেই বললেই চলে।

সংবাদ মাধ্যমের সংখ্যা বাড়ছে। সরকার গণমাধ্যম সম্প্রসারণের কথা গর্বের সঙ্গেই বলছে। কিন্তু সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিন দিন কমছে, ঝুঁকি বাড়ছে। সাংবাদিকদের ঝুঁকির মধ্যে রেখে মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়। সাংবাদিক নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই সবিনয়ে দাবি জানাতে চাই, অন্যান্য পেশাজীবী-নেতৃত্বের চেয়ে আপনাদের অবস্থান দুর্বল কেন, দয়া করে একবার ভাবুন।   নেতৃত্বের অবস্থান শক্তিশালী না হলে আক্রান্ত সহকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোও সম্ভব নয়। আর যে নেতৃত্ব তার সহকর্মীদের পাশেই দাঁড়াতে পারে না, সে নেতৃত্ব সবক্ষেত্রেই ক্রমান্বয়ে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে ---এটাই স্বাভাবিক।

রাশেদ মেহেদী : বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক সমকাল

বাংলাদেশ সময় : ১৬৫৯ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১৫
সম্পাদনা: জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।