বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘প্রাচ্যের দিকে তাকাও’ নীতি অনুসারে বর্ষপূতির মধ্যেই নেপাল, ভুটান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়া সফর সেরেছেন। প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানো এবং বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল দেশরূপে বিশ্বের মানচিত্রে নিজের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত রাখাই বিজেপি সরকারের বিদেশনীতির প্রধান লক্ষ্য।
দীর্ঘকাল বাদে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আসন্ন বাংলাদেশ সফর দুই প্রতিবেশী দেশের জনগণের মনে কি বার্তা নিয়ে আসবে সে দিকেই সমগ্র বিশ্বের সব ভাষার মানুষ তাকিয়ে। রবি কবির লেখা গান দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত। অবিভক্ত বাংলার স্মৃতি দুই বাংলার মানুষের মধ্যে আজোও প্রখর। বিশেষ করে ৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের রক্তাক্ত ইতিহাস, ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি। বহু বছর বাদে এই ঢাকা-নয়াদিল্লির মুখোমুখি সাক্ষাৎকালে বেশকিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
দু’দেশের এখন প্রধান সমস্যা মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, ভারতের দাদাগিরি ও উগ্র জাতীয়তাবাদ। প্রত্যেক সীমান্তে নীরিহ গ্রামবাসীকে হত্যা অথবা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে শ্রীনিবাসনের কারচুপি বাঙালি জাতির মধ্যে ঘৃণা অবিশ্বাস ও সন্দেহের বীজ বপন করে।
বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুর্খাজির সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার দেখা না করা আমাদের কাছে অপমানজনক। এবার পারস্পারিক রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনায় নতুন দিগন্ত খুলে যাবে বলে আশা। নতুন ইতিহাস শুরু হবে। বিগত দশকগুলিতে কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে ট্রেন ও বাস পরিষেবা দুই কালের মানুষকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। পর্যটন ও পরিবহন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এখন স্পষ্ট।
কলকাতা-মাদ্রাজের হাসপাতালে বাংলাদেশ থেকে আসবে অসংখ্য রোগী এবং আজমীর শরীফে ধর্ম যাত্রীর ভিড়। শিক্ষা, বিদ্যুৎ, ভারী শিল্প ও ওষুধ শিল্পে এবার কিছু নতুন কিছু নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মোদি তার সঙ্গে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে যাবেন। খুলে যাবে গৌহাটি-শিলং-আগরতলা যাওয়ার নতুন পথ। সীমান্তহাট তৈরি করা হবে। ভারতীয় পার্লামেন্টে সর্বসম্মতভাবে ছিট হস্তান্তর চুক্তিকে সমর্থন করা হয়েছে, কিন্তু পদ্মা ও তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন।
ভিসা সমস্যা দীর্ঘদিনের অথচ সার্কভুক্ত দেশ নেপাল, ভুটানে যেতে ভারতীয়দের ভিসা লাগে না। একদা পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় নেত্রী মমতা ব্যানার্জি স্থল চুক্তির বিরোধী ছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকা সফর করে জ্যোতি বসুর মতো তিনিও মুগ্ধ ও আবেগে আপ্লুত। শাহাজাদপুর, শিলাইদহ, সাগরদাঁড়ি, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের সংস্কৃতি এপারের শত সহস্র বুদ্ধিজীবীদের উদ্ধুব্ধ করে। যেমন করে ওপারের বাংলাদেশি ভাই বোনকে শান্তি নিকেতন, মুম্বাই ও কাশ্মীর।
এবার সুন্দরবন ও পরিবেশ, চোরাচালান, শিশু ও নারী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যৌথ ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনা প্রবল। বন্দি বিনিময় চুক্তি বা অপরাধীদের প্রত্যার্পন চুক্তি, ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাশিদের আসন সংরক্ষণ দ্বারা সুস্থ সুন্দর আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখা সম্ভব।
তবে নতুন কিছু হওয়ার চেয়ে ধীরে ধীরে সতর্ক পথ মেপে এগোনো উচিত। দু’দেশের জনগণের মন নিয়ে যে অপপ্রচার রাজনৈতিক স্বার্থে করা হয় সেই প্রবণতা বন্ধের জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি ও ১লা বৈশাখের আবেগ হোক প্রধান অস্ত্র। আশা করা যায় মোদি হাসিনার শীর্ষ বৈঠক এক নতুন আশার পথ দেখাবে। এভাবে হয়তো সবকিছু পাবো না, তবে অনেক কিছু্ই পাবো।
ড. অমিতাভ চক্রবর্তী
অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
নেতাজী সুভাষ বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১৫
এএ