'শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার'। তিন-চার দশক আগে এ কথা বাংলাদেশের প্রায় সব শহরের দেয়ালে লেখা থাকত।
এখন দেশব্যাপী অসংখ্য মেডিক্যাল কলেজই শুধু না, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও প্রচুর। তবে এদের মধ্যে মানসম্পন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা পনেরো থেকে বিশটার বেশী হবে না। মান বজায় রাখতে না পারলেও ব্যাঙের ছাতার মত এতো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবার কারণ কী? প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকার কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয়েরও চাহিদা থাকা স্বাভাবিক। তাছাড়া, নিশ্চয়ই এটি একটি লাভজনক উদ্যোগ, নতুবা এতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হতো না।
শিক্ষা কোন পণ্য নয় বলেই আমরা বিশ্বাস করি। তবে আজকের পৃথিবীর বাস্তবতায় শিক্ষার বানিজ্যিকীকরণটা প্রকটভাবেই চোখে পড়ে। আমরা স্বীকার করি আর নাই করি, শিক্ষাও এখন পণ্য। তবে তা যে কোনো ধরনের পণ্য নয়। আর যেহেতু নাগরিকরা ভাল মানের শিক্ষা পেলে ঘুরে ফিরে দেশেরই লাভ, সেহেতু শিক্ষাকে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ হিসেবেও বিবেচনা করা যায়।
সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার উপরে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন করছে। তাদের আন্দোলন ক্রমশ ব্যাপ্তিলাভও করছে। দেশব্যাপী এটি এখন অন্যতম আলোচনার বিষয়। ব্যাপারটি নিয়ে রাজস্ব বোর্ড আর অর্থমন্ত্রীর ভিন্ন বক্তব্য পরিস্থিতি আরো জটিল করেছে।
রাজস্ব বোর্ড বলছে, ছাত্র-ছাত্রীরা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভ্যাট দেবে। আর অর্থমন্ত্রী বলছেন, আগামী বছর থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা ভ্যাট দেবে। আমরা কোনটাকে সত্য বলে ধরে নেবো?
ভ্যাট হল মূল্য সংযোজন কর, এটি তো সেবা গ্রহীতা বা ক্রেতার দেবার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেহেতু শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করছেন, সেহেতু তাদের কর দেবার কথা। এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে যদ্দুর জানা গেল, ট্রাস্টি বোর্ড পরিচালিত হওয়ায় তারা সরকারকে নাকি কোন কর দেন না। তাহলে মুনাফার টাকা যায় কোথায়? নাকি মালিক পক্ষ আসলে দাতা হাতেম তাই!
মান বিন্যাসে বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চার-পাঁচ স্তরে ভাগ করা যায়। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে খুব ভাল মানের, আবার কিছু আছে স্রেফ সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্র! এদের কর্মকাণ্ড দেখার দায়িত্ব যাদের, তারা তবে কী করেন? আর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফিসহ সব ফি কিভাবে এবং কারা নির্ধারণ করেন?
শুরুর দিকে বিত্তবানদের সন্তানরাই মূলত পড়লেও এখন অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। ভ্যাট বা যে কোন কারণে শিক্ষা ব্যয় বাড়লে খুব সঙ্গত কারণেই এসব পরিবারের উপর বাড়তি চাপ পড়ে। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে চলমান ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন যুক্তিসঙ্গত। যদিও এই আন্দোলনকে সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ দিতে কতিপয় রাজনৈতিক দলের অপতৎপরতা ইতিমধ্যেই চোখে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জামায়াত-বিএনপিপন্থি এক শিক্ষকের ছবি দেখলাম ফেসবুকে, নেপথ্যে থেকে আন্দোলনে হাওয়া দিচ্ছেন। জয় বাংলাকে ব্যঙ্গ করে শ্লোগানও দেখলাম কারো কারো প্ল্যাকার্ডে। এসব বিচ্যুতি চলমান আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
তবু আন্দোলন চলছে। এর একটা আশু সমাধান প্রয়োজন। আন্দোলনকারী বা তাদের সমর্থক হিসেবে আমরা যেহেতু বলছি শিক্ষা কোন পণ্য নয়, সেহেতু ভ্যাট বাতিলের পাশাপাশি আমাদের আরেকটু আগ বাড়িয়ে ভাবতে হবে। প্রদত্ত শিক্ষার মান অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার ফি নির্ধারণ করে দিতে হবে এবং তা অবশ্যই মধ্যবিত্তের সাধ্যের ভেতরে হতে হবে। ইচ্ছেমাফিক ফি নির্ধারণ, প্রায়শই এটা-সেটার উছিলায় টাকা নেওয়ার ফন্দিফিকির নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা নিয়ে ইচ্ছেমত ব্যবসা করবেন আর সরকার কর কিংবা ভ্যাট চাইলেই শিক্ষা পণ্য নয় বলে গলা ফাটাবেন, এই দ্বিমুখী অবস্থান চলতে পারে না।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত জরুরি ভিত্তিতে চলমান ছাত্র আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনা। প্রয়োজনে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট বাতিল করুন। সেই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কঠিন তদারকির আওতায় আনুন। তাদের শিক্ষার মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করুন, সেই সঙ্গে ভর্তি ফি'র পরিমাণও নির্ধারণ করে দিন।
শিক্ষাকে যদি পণ্য না ভেবে আমরা নাগরিক অধিকার এবং দেশের ভবিষ্যত বিনির্মাণে বিনিয়োগ হিসেবে কার্যকরভাবে বিবেচনা করতে পারি, তবে সবচেয়ে বেশী লাভবান হবে বাংলাদেশ।
ড: আবুল হাসনাৎ মিল্টন: কবি ও চিকিৎসক; বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াস্থ নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৫
জেডএম