নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা এখন কেবল অনুন্নত দেশগুলোতেই নয়, সারাবিশ্বেই একটি আলোচিত সমস্যা। বহু শতাব্দী ধরে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ হিসেবে দেখার পরিণতি এই নারী নির্যাতন।
এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল দেশে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ পক্ষ এবং ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ বা নির্মূল দিবস পালিত হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত এ প্রচারাভিযানের মূল লক্ষ্য হলো সবাইকে একথা জানানো যে, নারীর অধিকার মানে মানবাধিকার, নারী নির্যাতন মানে মানবাধিকার লঙ্ঘন। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ ১৬ দিনব্যাপী এই প্রচারাভিযানের প্রথম দিন অর্থাৎ ২৫ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তারপর থেকে বাংলাদেশেও ২৫ নভেম্বর নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস পালিত হয়ে আসছে, এই দিবসের মাধ্যমে পালিত হয়ে আসছে ১৬ দিনের প্রতিবাদ পক্ষও।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিদিনকার ঘটনা। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে পদে পদে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী ও মেয়ে শিশুরা। নারী নির্যাতন যে কতোটা ভয়াবহ ও সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে তা প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এই সমস্যা বিদ্যমান। বাংলাদেশজুড়ে নারী নির্যাতন নানা রূপে এবং মাত্রায় সংঘটিত হচ্ছে এবং এর ফলে আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ধর্ষণ, হত্যা, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের কারণে নির্যাতন, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ইত্যাদি বহুমাত্রিক সহিংসতা নারীর জীবনের নিত্যসঙ্গী। প্রতিটি নির্যাতনেরও রয়েছে বিভিন্ন রূপ ও মাত্রা। আজকাল গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো যোগ হয়েছে সাইবার ক্রাইম বা মোবাইল, ইন্টারনেট, ফটোশপ ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারী ও কিশোরীদের হয়রানি ও নির্যাতন। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের পাশাপাশি এ কারণে হত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন কতোজন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়, এর সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই। কারণ সব ঘটনার মামলা হয় না, অনেকেই লোকলজ্জার ভয়ে এসব চেপে যান। সব ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিতও হয় না। নির্যাতন যে পরিমাণ ঘটে তার চেয়ে অনেক কম খবরই প্রকাশিত হয় কিংবা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নজরে আসে।
বস্তুত নারীর প্রতি প্রচলিত নেতিবাচক পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব যেন নারীকে সাধারণত পুরুষের অধস্তন ও হেয় করে দেখা হয়, সেটিই সমাজে নারীর হীন অবস্থা ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার প্রধান কারণ। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইনকানুন, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও প্রথার কারণে নারী নির্যাতন বাংলাদেশের সমাজে অনুমোদিত। নতুন অবক্ষয়ী, সন্ত্রাসী সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদ্ভব, আইনগত কাঠামোর মধ্যে দুর্বলতা, প্রশাসনে জেন্ডার সংবেদনশীলতার অভাব এবং সার্বিকভাবে আইন ও শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির কারণেও নারী নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। নারী নির্যাতনের মূল কারণ কেবল ব্যক্তি হিসেবে নারীর প্রতি হীন ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, বরং নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সম্মিলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী।
বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ আজ নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছে। সোচ্চার হয়ে উঠছে সবাই। বস্তুত আমাদের সবারই উচিত নারী নির্যাতন নিয়ে কথা বলা। অন্যদের কথা বলতে উৎসাহিত করা। কেননা আমরা যদি নারী নির্যাতনমুক্ত সুস্থ সমাজ চাই, তবে মনে রাখতে হবে, নিজে নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকাটাই যথেষ্ট নয়। বরং আপনার আশেপাশে ঘটে যাওয়া যে কোনো নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে সম্মিলিতভাবে। কারণ, নারী নির্যাতনকে টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বেশি দায়ী আমাদের নীরবতা।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের দেশে বেশ কিছু আইন রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতার অভাবে কিংবা আইনের ফাঁক-ফোকরের কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এর ফলে একদিকে যেমন অন্য অপরাধীরা উৎসাহিত হয়, অন্যদিকে নির্যাতিত নারীরাও আইনের আশ্রয় নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিছু কিছু নির্যাতনের ক্ষেত্রে আইনের অভাবও নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী। সিডও সনদ, বেইজিং প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশনসহ নারী নির্যাতন বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আন্তর্জাতিক দলিল প্রণীত হয়েছে, কিন্তু যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে নারী নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। তাই এগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাতে হবে আমাদের। বিশেষ করে নারী নির্যাতন রোধে পর্যাপ্ত অর্থ ও সম্পদ বরাদ্দ, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা, ইতিবাচক আইনের প্রয়োগ এবং জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের ব্যাপারে সরকারের জবাবদিহিতার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া প্রয়োজন।
নারী নির্যাতনকে ব্যক্তিগত সমস্যা মনে করে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আমাদের সবারই এটি প্রতিরোধে কিছু না কিছু করার আছে। কারণ এর ভুক্তভোগী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। নারী ও মেয়ে শিশু নির্যাতনের ভয়াবহতা, কষ্ট, যন্ত্রণা ও ক্ষতি পরিমাপ করা কখনোই সম্ভব নয়। এর পরিণাম এতটাই ভয়াবহ যে, অনেকেরই স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হয়। কেউবা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সমাজ থেকে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে কেউ কেউ, আবার কারও ক্ষেত্রে সর্বশেষ পরিণতি হয় মৃত্যু। সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী এবং ভবিষ্যতের কাণ্ডারী মেয়ে শিশুরা যদি শুধুমাত্র তাদের লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে নির্যাতনের মুখোমুখি হয়ে স্বাভাবিক সৃজনশীলতা ও কর্মস্পৃহা হারিয়ে জড়বস্তুতে পরিণত হয়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে তা নিশ্চিতভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে।
এ পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার মন-মানসিকতা থেকেই যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারীবিরোধী, নারীবিদ্বেষী কিংবা নারীর বিরুদ্ধে অবজ্ঞামূলক মনোভাব, অন্ধ কুসংস্কার, নেতিবাচক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এ লক্ষ্যে শিশুকাল থেকে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জেন্ডার-সংবেদনশীল একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে এবং নারী-পুরুষের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। সর্বস্তরে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে এবং জাতীয় ও তৃণমূল পর্যায়ের সরকারি, বেসরকারি, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নারী ও মেয়ে শিশু নির্যাতনকে ‘পারিবারিক ব্যাপার’ হিসেবে বিবেচনা করে আমরা অনেকেই এটা নিয়ে কথা বলতে বা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে উৎসাহী হই না। কিন্তু এখন সময় এসেছে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে নীরবতার সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার এবং এর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-প্রতিকারে এগিয়ে আসার। নিজের পরিবার থেকেই এর চর্চা শুরু করতে হবে।
লেখক: সমন্বয়কারী, স্টেপস্ টুয়ার্ডস্ ডেভেলপমেন্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
এইচএ