অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি বহু বছর, তবু প্রায় প্রতিটি বইমেলার শুরুতে ঢাকায় থাকার চেষ্টা করেছি। একুশের বইমেলা, ভাষা শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানো, কত ব্যস্ততায় যে ফেব্রুয়ারির দিনগুলো কাটে।
পেশাগত ব্যস্ততার জন্য এবার দেশে যেতে পারিনি। জীবন যে পথে হাঁটছে, তাতে আগের মত 'প্রায়ই দেশে যাবার ব্যাপারটা' আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। অথচ এবারের বইমেলা নিয়ে আমার অনেকদিনের পরিকল্পনা ছিল। এবছর জুলাইয়ে আমার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে। ইচ্ছে ছিল তাই দেশে গিয়ে বইমেলায় আমার নির্বাচিত কবিতা সংকলন প্রকাশ করব। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল, নাম দিয়েছিলাম 'জলের কবিতা'। ঢাকায় যাইনি বলে শেষমেষ কিছুই হল না।
এবার সিডনির বইমেলার আগের সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু ফাউণ্ডেশনের পক্ষ থেকে কবিতা পাঠের আসর আয়োজন করেছিলাম। ছোট্ট পরিসরে সুন্দর আয়োজন। অনেকে মিলে কবিতা পড়লাম, দল বেঁধে আন্তর্জাতিক মাতৃসৌধে ফুল দিলাম। অনুষ্ঠানটি আয়োজনে একুশে একাডেমির আন্তরিক সহযোগিতাও পেয়েছি। তবু পরেরদিন সকালে উঠে আর মেলায় যেতে ইচ্ছে করল না। মেলায় আমার কোন বই নেই। প্রতিবার ঢাকা থেকে ক্যুরিয়ারে করে আকাশ পথে পঁচিশ কেজি বই আনি, এবার তাও নেই। ঢাকা থেকে বই আনতে না পারাটাই আমাকে সবচেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছে।
গত ডিসেম্বর মাস থেকে বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আকাশ পথে ক্যুরিয়ারে মালামাল আনার ব্যাপারে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। কূটনৈতিক লাগেজ, পাঁচশ’ গ্রামের বেশী ডকুমেন্ট এবং আরো দুয়েকটি জিনিস বাদে আর কোনকিছুই পরবর্তী অধ্যাদেশ জারি না হওয়া পর্যন্ত আকাশ পথে ক্যুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আনা যাবে না। অর্থাৎ আগের মত আর কার্টুন ভরে ঢাকা থেকে সদ্য প্রকাশিত নতুন বই আনা যাবে না।
হঠাৎ করেই কেন জানি বাংলাদেশের সাথে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্কটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর সব ক্রিকেট দল বাংলাদেশে খেলে নিরাপদে ফিরে আসে, কিন্তু নিরাপত্তার অযুহাতে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল যায় না। তাদের এই না যাওয়াটা তখন আর শুধু ক্রিকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বাংলাদেশের ইমেজের উপর এসে পড়ে। এর সাথে এখন যোগ হয়েছে ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নিরাপত্তার মান নিয়ে সংশয়। এর ফলে ঢাকার সাথে আকাশ পথে পণ্য পরিবহনের ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে। আর এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা অনেকেই। যেহেতু নিরাপত্তার বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং অস্ট্রেলিয়ার সরকার তার নাগরিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে খুবই সচেতন, তাই এসব সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। তবে ব্যাপারটা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জন্য বিব্রতকর। ঠিক বুঝতেও পারি না, এ নিয়ে সম্মিলিতভাবে আমাদের কিছু করার আছে কী না।
তাই মন খারাপ করে হোটেলে বসে থাকি। সকাল গড়িয়ে দুপুর, অবশেষে বিকেলের দিকে বই মেলায় যাই। প্রিয় মানুষগুলোর সাথে দেখা হয়। কিন্তু বইয়ের দোকানগুলোর ধারে কাছেও যাই না। এবারের মেলায় শেষ বিকেলেও প্রচুর মানুষ, সাদা-কালো শাড়িতে অপরূপা সব তরুণীরা। দারুণ আয়োজন করেছে সিডনির একুশে একাডেমি। সবাই একুশের চেতনায়-উৎসবে উজ্জীবিত।
আমি শুধু মাঠের এককোনায় মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। এই প্রথম মেলার এতদিন পার হয়ে গেল, আমি সদ্য প্রকাশিত কোন বই ছুঁয়ে দেখলাম না। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা মাইল ফলকের কাছে দাঁড়িয়ে, অথচ আমি ঢাকার বইমেলায় নেই।
প্রথম প্রজন্মে যারা প্রবাসে এসে শেকড় গাড়ে, তারা আসলে কোথাও থাকে না। না দেশে না বিদেশে!
ড: আবুল হাসনাৎ মিল্টন: কবি ও চিকিৎসক, বর্তমানে নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত। ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৫
জেডএম/