ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

অগ্নিঝরা মার্চ বাঙ্গালির উত্থানপর্ব || জুয়েল মাজহার

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৮ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৬
অগ্নিঝরা মার্চ বাঙ্গালির উত্থানপর্ব || জুয়েল মাজহার

মার্চ মাস। বাঙ্গালি জাতির তিন হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল আর তাৎপর্যময় মাস।

এই মাসেই সূচিত হয়েছিল বাংলাদেশ তথা পূর্ববাংলার মানুষের চিরশৃঙ্খলমুক্তির যাত্রাবিন্দু রচনা। এই মাসটিকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আবেগও তাই সব সময় থাকে তুঙ্গে। এর বাইরে মানুষের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালেও মার্চ মাসের অন্যরকম এক প্রতীকী তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যাবে।

প্রাচীন রোমান ক্যালেন্ডারবাহিত হয়ে ‘March’ শব্দটি এসেছে ইংরেজি ভাষায়। মূলত রোমান শব্দ Martius বা Mars থেকে যার উৎপত্তি। রোমানদের কাছে মার্চ মূলত বীরত্বের, যুদ্ধের, প্রতিরোধের, স্বভূমির জন্য লড়াইয়ের প্রতিভূ হিসেবে গণ্য। মোদ্দা কথা, মার্চ মাস ছিল রোমানদের কাছে বিপুল উত্থান আর উজ্জীবনের বীজমন্ত্র: ‘ Mars is the icon of these fiercely proud, patriotic and heroic qualities.’।

ইংরেজ কবি শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকেও এসেছে মার্চ মাসের তাৎপর্যের প্রসঙ্গ। আধুনিককালে এসে ১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গের বাঙ্গালির কাছেও মার্চ মাস বিপুল তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। কেননা এই মার্চই হলো বাঙ্গালির স্বাধীনতার জন্মমাস। অর্থাৎ মার্চ হলো প্রথমবারের মতো নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করার, পরাধীনতা থেকে চিরমুক্তিলাভের প্রথম সোপান। দীর্ঘ সংগ্রামের চূড়ান্ত সফলতার পথে জোর কদমে এগিয়ে চলার মাস। অন্যদিকে প্রাচীন পৃথিবীতে মার্স, মারসিউস বা মার্চ মাস ছিল রোমান ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস।

 প্রবল আর আপসহীন আত্মঘোষণার মাস হওয়ার সুবাদে মার্চ তাই স্বাধীন বাঙ্গালি জাতির জন্মের প্রথম স্বাক্ষর রচনার মাস। এটি একাধারে সংগ্রামের, ত্যাগের, আত্মবলিদানের আর গৌরবের স্মৃতিবাহী। একাত্তরের ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালেই তা টের পাওয়া যায়। পুরো মার্চ মাসটাই ছিল দুনিয়াকাঁপানো নানা ঘটনায় মুখর আর উত্তাল। সেসব ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যময় কয়েকটি ঘটনা হয়ে আছে ইতিহাসের মাইলস্টোন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাপাঠ আর সে-সূত্রে মুক্তির যুদ্ধের জন্য বাঙ্গালির অস্ত্রধারণ।

মার্চে বাঙ্গালির এসব গৌরবজনক বীরত্বগাথার অন্য পিঠে আছে বর্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি ও তাদের লেলিয়ে দেওয়া সামরিক বাহিনির নানান নারকীয় তাণ্ডব। ২৫ মার্চের কালো রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসহ ঢাকা শহরের নানা স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষের ওপর যে নৃশংস নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, মানবেতিহাসে সে বর্বরতার তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার।   

শান্তিকামী বাঙ্গালি তার তিন হাজার বছরের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে একের পর এক বিদেশি হানাদার শক্তির দু:শাসনের মুখোমুখি হয়েছে। সেসবের বিরুদ্ধে বাঙ্গালি প্রতিবারই বুক টান করে রুখে দাঁড়িয়েছে। বাংলার বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম বীর ঈসা খাঁ তেমনই এক উজ্জ্বল উদাহরণ। মুগল সেনাপতি মান সিংহকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্‌বান করে তাকে পরাস্তও করেছিলেন ঈসা খাঁ। এরকম নানান প্রতিরোধ-সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙ্গালির ইতিহাস। কিন্তু তার পরও বাঙ্গালি কখনোই বিদেশি শাসন-শোষণের শৃঙ্খল থেকে চিরমুক্তি লাভ করতে পারেনি। ব্যতিক্রম কেবল ১৯৭১ সাল। আরো ভালো করে বললে একাত্তুরের অগ্নিঝরা মার্চ। যে মাসটি চিরশৃঙ্খলমুক্তি আর চির উত্থানের লঞ্চপ্যাড বা উৎক্ষেপণমঞ্চ। যেখান থেকে মুক্তির পথে যাত্রা শুরু করে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি বাঙ্গালিকে। হবেও না কোনোদিন। একাত্তরের মার্চ মাস ‘পরাধীনতা’ শব্দটিকে চিরতরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে অতীতের গর্ভে।

একাত্তরের ২৬ মার্চ তারিখে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই ৭ মার্চ তারিখেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নামের এক বাঙ্গালি মহামানবের বজ্রকণ্ঠে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কথা কয়টি ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘স্বাধীনতা’ চিরকালের জন্য আমাদের হয়ে গেল। ঘরে ঘরে রচিত হতে থাকল দুর্গ।

এ-ভূখণ্ডের মানুষের কাছে মার্চ হয়ে উঠল এক মহা-উত্থানের প্রতীক। বাংলাদেশ নামের গাঙ্গেয় বদ্বীপ চিরকালের মতো আকাশে উড়িয়ে দিল তার চিরমুক্তির অমর পতাকা। নদী-খাল বিধৌত আর অরণ্যমেখলা শ্যামলিম দেশের গগন আলো করে মার্চে উদিত হল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য; যা কখনোই অস্ত যাবে না। অন্যদিকে নিজের পাপের ভারেই বাংলার আকাশ থেকে অস্তাচলগামী হলো পাকিস্তান নামের দুষ্ট গ্রহ।

’৪৮, ’৫২, ’৬২, ’৬৬, সবশেষে ৬৯’ --- এই ২৩ বছরের বেশি সময় ধরে যে মহাজাগরণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল, তারই চূড়ান্ত পরিণতির দুয়ার খোলার মাহেন্দ্রক্ষণটি উপহার দেয় ১৯৭১-এর বিপুল রক্তঝরা, আগুনঝরা মার্চ। এভাবেই মার্চ হয়ে উঠল সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালির নিজেকে চেনার ও চিনিয়ে দেবার মাস।

 ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে, তা দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করত হবে...’-- বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের এই ঘোষণা  বাস্তবায়নে ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ বাঙ্গালি মার্চেই ঝাঁপিয়ে পড়ল দুর্নিবার উদ্যমে। এরপর কেবল মারের বদলে মার।

ইয়াহিয়া, ভুট্টো আর টিক্কা খানদের তখত-এ-তাউস কাঁপানো মার্চের তুলনা কেবল মার্চ। গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসেই এর তুলনা বিরল। বাঙ্গালির ত্যাগ আর সফলতা অর্জনের এমন সাক্ষী নয় আর কোনো মাস। এতো নৃশংসতার সাক্ষীও নয় আর কোনো মাস। এমন বিপুল ঐক্যের উদ্বোধকও নয় আর কোনো মাস। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে আপামর মানুষের রুখে দাঁড়াবার, ফুঁসে উঠবার, মারের বদলে মার দেবার সাক্ষী নয় আর কোনো মাস।

মার্চের গৌরব বুকে ধারণ করে আমরা এখন অন্য এক লড়াইয়ে লিপ্ত। দারিদ্র্যকে জয় করার, অশিক্ষাকে জয় করার, অন্ধত্ব ও পশ্চাদপদতাকে হটিয়ে দেবার লড়াই; যাবতীয় বৈষম্য আর অন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে এক উদার, মানবিক, আর মাঙ্গলিক দেশ গড়ার লড়াই। এ লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৬

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।