ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

‘একসঙ্গে’ ভবিষ্যতের পথ দেখিয়েছে

মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৬
‘একসঙ্গে’ ভবিষ্যতের পথ দেখিয়েছে

লেখক রমেন দাশগুপ্ত। আমার মতো একজন ছাপোষা সরকারি কর্মকর্তা ‘একসঙ্গে’ একই শহরে থাকি।

ব্যক্তি রমেনের সাথে আমার পরিচয় আছে। সেটা আমি নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারি। কিন্তু লেখক রমেনের সাথে আমার পরিচয় আছে–সেটা ভাবলে মনে হয় স্বপ্ন দেখছি। কারণ কবি-লেখক জীবিত আছেন সেটা ভাবাই যায় না। পাঠ্যবইতে কবি-লেখকদের নামের ডান পাশে ব্র্যাকেটের মধ্যে দুটি সাল লেখা দেখতে দেখতে একটা আশৈশব মাইন্ড-সেটআপ গড়ে উঠেছে। তাই ব্যক্তি রমেন কিংবা সাংবাদিক রমেনকে টেনেটুনে সাহস করে যদি ধরেও নেই যে আমার পরিচিত, তথাপি লেখক বা ঔপন্যাসিক রমেন আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে।
 
‘গণজাগরণ মঞ্চ’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অভিনব ব্যাপার। পুরো বিষয়টা আচমকা, আচানক এবং খানিকটা বিস্ময়কর। ফলে রাজনীতির মানচিত্রে এটার জায়গা থাকলেও নির্ধারিত স্থানটি কোথায় তা অমিমাংসিত রয়ে গেছে। লেখকও এটার জবাব দিতে চাননি। যুগসন্ধিক্ষণে চরিত্ররা যা করেন তিনিও চরিত্রগুলোকে সেভাবেই এগুতে দিয়েছেন। এমন কি চরিত্র চাটগাঁইয়া টানে শুদ্ধ বাংলা বলছেন, সেটাও লেখক তথাকথিত ‘জাতেউঠা’র জন্যে এড়িয়ে যাননি। ঠিক হুমায়ূন আহমেদ যেটা করতেন। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসে পাভেল করচাগিন অন্যতম প্রধান চরিত্র। এখানেও স্বকৃত পাভেল নামক চরিত্র আছে। নামের একটি অংশ মিল না থাকলেও অমিল অংশে র্‌-ধ্বনি এবং ক্‌-ধ্বনির প্রাধান্যে মিল আছে। পাভেলের জন্য তানিয়া না থাকলেও অভির প্রেমিক প্রিয়ন্তী নামের মধ্য তানিয়ার আবেশ লুকিয়ে রয়েছে। অভি প্রিয়ন্তীকে ফিরিয়ে দিলেও এটা কাপুরুষতা বলবো না। বরং পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান। এটাতে বড় একটা ম্যাসেজ আছে।
 
প্রেম করলেই হাত ধরে বেরিয়ে বিয়ে করে-এটা সবসময় সত্য নয়। কোনো কোনো চরিত্র ধর্ম এবং মাদ্রাসা নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তাদের বক্তব্যের সত্যতা থানা-পুলিশ-প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য প্রাসঙ্গিকভাবে তদন্তের বিষয়। তবে এ ধরনের ধারণা পোষণকারী ও মন্তব্য প্রদানকারী মানুষ সমাজে আছে। লেখক সমাজে যা দেখেছেন তা-ই বিধৃত করেছেন। সংকোচ করেননি কিংবা রাখঢাক করেননি। এটাই লেখকের সততা। তিনি মনুষ্য স্বত্বার প্রতি সুবিচার করেছেন। চেরাগি পাহাড় আমাদের চট্টগ্রামের নগর কেন্দ্রিক সভ্যতার সূতিকাগার। শাহ্‌বাগের বুদ্ধিজীবীদের মতো চেরাগির আড্ডাবাজরা গুরুত্ব পাওয়াতে ভালো লেগেছে।
 
জিইসি, চকবাজার, জামালখান, লিচুতলা, হাজারি লেন ইত্যাদি নামগুলো আসাতে বড্ড ভালো লেগেছে। এতদিনে আমাদের প্রিয় জায়গাগুলো বুঝি গড়ের মাঠ, চৌরঙ্গী কিংবা পার্কস্ট্রিটের মতোই সাহিত্য হয়ে উঠল! কমরেড হয়ে গেল উজির। কাজেই বামেদের সাম্পান তো ধীরে চলবেই। লেখক অভিমানী কণ্ঠে সেটাই শুনিয়ে দিয়েছেন গল্প বলার শুরুতেই। আর পাগলী বুড়ির দুঃখে কাঁদছে নীরা। লেখক নীরা নামটিই-বা দিলেন কেন! একি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের তেত্রিশ বছরের হাহাকার নাকি বরুনার ফিরিয়ে দেওয়া ১০৮টি নীলপদ্মের কষ্টকর নীলিমা! কখনো রবি ঠাকুরের মতো পরিশীলিত। কখনো বিদ্রোহীর মতো তেজোদীপ্ত। আবার সুকান্তের মতো সাম্যবাদী বজ্রকণ্ঠী। কখনো ম্যাক্সিম গোর্কির মতো সমাজ জাগানিয়া।
 
বিষয়ে নতুনত্ব আছে উপন্যাসে। কিন্তু অনুভবে প্রাচীন-পুরাতন। এই জন্য উপন্যাসের পরতে পরতে লেখকের প্রকাশভঙ্গি বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছে কালজয়ী লেখকদের। এটি একই সাথে লেখকের ত্রুটি। আবার একই সাথে গুণও। কারণ লেখকের মনের গভীরে হয়তো হাজারো লেখকের আনাগোনা। চাইলেও তাদের লুকিয়ে রাখা যায় না।
 
যাই হোক, গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা প্রত্যেকেরই থাকতে পারে। তবে এটা নিশ্চিত যে, এটাকে কেন্দ্র করে নানামুখী চিন্তা-চেতনা, আলোচনা-সমালোচনার উত্তাপ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ছুঁয়ে গেছে। পক্ষে হন কিংবা বিপক্ষে হন অথবা নিদেন পক্ষে নিরপেক্ষ হলেও আপনার জানা দরকার-উত্তাল সেই দিনগুলোতে কিছু তরুণ কী করেছিল-কী ভেবেছিল। সমরেশের ‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাসের সেই তরুণ-তরুণীরাই কি ফিরে এসেছিল ‘একসঙ্গে’ উপন্যাসে ভর করে!নাকি অন্য কিছু?
 
‘একসঙ্গে’ উপন্যাসে সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানসিক টানাপোড়েন এবং ইতিহাসের গতিধারা সবই হৃদয় আবিষ্ট করার মতো। সাহিত্য জগতে অনেকেই ইতিহাসকে কেন্দ্র করে সাহিত্য রচনা করেছেন। তবে সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতিহাসকে ফেলে আসার দীর্ঘদিন পর। কিন্তু সমকালীন রাজনৈতিক বিস্ময় কিংবা অতীব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে ইতিহাসকে সমান্তরালে রেখে এ ধরনের গল্প শুরু করে শেষ পর্যন্ত তা নিয়ে যাওয়া এক বিশাল সাহসিকতা।
 
এটাও লক্ষণীয় যে, বর্তমান সময়ে অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্ব এ উপন্যাসে ঢুকে পড়েছেন অনিবার্যভাবে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে লেখকের অসাধারণ মুনশিয়ানায় গল্পকে জড়িয়ে ধরা চেতনা কিংবা চেতনাকে জড়িয়ে ধরা গল্প সাবলীলভাবে ভবিষ্যতের পথ দেখিয়েছে।
 
‘একসঙ্গে’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ চমৎকার ও প্রাসঙ্গিক হয়েছে। মুদ্রণও বেশ ভালো। ফন্ট অতিরিক্ত বড় করে বইয়ের দাম বাড়ানোর অপচেষ্টা হয়নি। দামও সাশ্রয়ী। ইচ্ছে করলে উপন্যাসটি কিনতে পারেন যে কেউ।
 
মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান: বিচারক (যুগ্ম জেলা জজ), ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, পিরোজপুর
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৬
টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।