সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডের বাঙালি কমিউনিটি নিয়ে একটি লেখা পত্রিকায় প্রকাশের পর ঢাকার ধানমন্ডি থেকে জনাব আবুল হোসাইন লিখলেন : ‘মেনি থ্যাংকস ফর ইউর ওয়ান্ডারফুল রাইটিং। আই হেভ অলরেডি ভিজিটেড গ্রিস, ইটালি, অস্ট্রিয়া, জাপান, সাউথ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড মেনি কান্ট্রিজ।
আবার পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া থেকে দীপক রায় নামে এক ভদ্রলোক ধন্যবাদ জানিয়ে লেখাটির প্রশংসা করেন এবং আমি কমিউনিটির কাছে যে দু-একটি সুপারিশ রেখেছি তাতেও তিনি সহমত পোষণ করেন। এও বলেন, এসব সমস্যা শুধু বাংলাদেশের বাঙালিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের বাঙালিরাও এ দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাই সময়-সুযোগ পেলে এসব বিষয়ে যেনো আমি আরো লিখি।
আমি কোনো জাত লেখক নই। ছোটবেলায় আমার প্রয়াত শিক্ষক বাবাকে দেখতাম, কোনো গরিব-দুস্থ, বিধবা বা সহায়-সম্বলহীন কেউ যখন সরকারের দেওয়া অনুদান ঠিকভাবে না পেয়ে ব্যথিত হৃদয়ে তাঁর কাছে এসে কান্নাকাটি করতেন, তখন তিনি বিবেকতাড়িত হয়ে ওইসব অসৎ চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে কলম ধরতেন। এতে মা অবশ্য রাগারাগি করতেন-- শুধু শুধু শত্র“তা বাড়িয়ে কী লাভ! আমিও সম্ভবত অনেকটা সেরকমই। পারিপার্শ্বিক কোনো সমস্যা বা অনৈতিক ঘটনা যখন আমার বিবেককে নাড়া দেয়, আলোড়িত করে, তখনই আমি কিছু লিখতে চাই।
২৫ জুলাই আয়ারল্যান্ডে নির্বাচন। না, এটা আইরিশ সরকারের স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচন নয়। এটা বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন। পুরো আয়ারল্যান্ডের বাঙালি কমিউনিটিতে এ নির্বাচন নিয়ে চলছে কানাঘুষা। নির্বাচন পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটিও গঠিত হয়েছে।
প্রতিটি কাউন্টি থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে যে আহ্বায়ক কমিটি তৈরি করা হয়েছিল সে কমিটি ও নির্বাচন কমিশন মিলে একটি বিধি প্রণয়ন করে। তা হলো : ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব আয়ারল্যান্ড’-এর প্রতিনিধি নির্বাচনে আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত ছাত্র-ছাত্রীরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন না। এটি শিক্ষার্থীসহ অনেক বিবেকবান মানুষের মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে সংগঠনটির যে সুস্থ-সুন্দর ও স্থায়ী কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো তার আগেই কমিউনিটি ভেঙে দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। এক পক্ষ মাইনাস ফর্মুলায় নির্বাচনে আগ্রহী, অন্য পক্ষ শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কেবল নির্বাচনে অংশ নিতে চান। শিক্ষার্থীবিহীন নির্বাচনমুখীদের বক্তব্য : ছাত্ররা এখানকার অস্থায়ী বাসিন্দা, আজ আসে তো কাল যায়, তাদের ভোটাধিকার দেওয়ার দরকার কী! তারা আমাদের ছোট ভাই, ছোট ভাইয়ের মতোই থাক। পক্ষান্তরে অন্য পক্ষের মতামত মূল্যায়ন করলে যা বুঝা যায় তা হলো : আমরা সংগঠন করছি আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত পুরো বাঙালি কমিউনিটি নিয়ে। এখানে কে ছাত্র, কে চাকুরে, কে স্থায়ী বা কারা আইরিশ পাসপোর্টধারী তা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। এ ধরনের সংকীর্ণ চিন্তাভাবনা নিজেদের মধ্যে শ্রেণীভেদের সৃষ্টি করে, যা একটি সফল সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নির্বাচনটি যেহেতু ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব আয়ারল্যান্ড’কে কেন্দ্র করে, সেহেতু দেশটিতে বসবাসরত যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি নাগরিকেরই ভোটাধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়।
এভাবে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তিই উত্থাপন করা যেতে পারে। তবে আমি বলবো, নিজ বিবেককে যদি কেউ বিচারকের আসনে বসিয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবেন তাহলে নিশ্চয়ই এর সঠিক উত্তর পাবেন। ছাত্রদের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। সেদিকে নজর দেবো না। শুধু বলবো, স্থায়িত্বের মতো ঠুনকো অজুহাতে ভোট প্রয়োগ থেকে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত রেখে তাদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা মোটেই ঠিক নয়। আয়ারল্যান্ড-প্রবাসী বাঙালিদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আজ আমরা যারা পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি বা লাল পাসপোর্টের বড়াই করি, কয়েক বছর আগেও তাদের যখন বছর বছর ওয়ার্ক পারমিট নবায়নের মাধ্যমে এ দেশে থাকতে হতো (যদি কোনো কোম্পানি কারো ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন করতে অপারগতা প্রকাশ করে তবে তাকে আইনানুযায়ী দেশে ফিরে যেতে হবে), তখনো আইরিশ সরকার ছাত্রসহ প্রতিটি বাঙালিকে স্থানীয় নির্বাচনে (মেয়র, কাউন্টি কাউন্সিলর) ভোটদানের সুযোগ দিতে একদম কৃপণতা করেনি। আমাদের স্থায়িত্বের কথাটাও ভাবেননি। আমার মনে আছে, ২০০৬-এ আমি যখন ভোট দিতে যাই তখন আমার ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ ছিল মাত্র তিন মাস। এরপরও তারা আমার ভোটদানের ক্ষেত্রে কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি। যেখানে ভোটাধিকারের দাবি উঠলেও উড়িয়ে দিতে পারতো, সেখানে একটি বিজাতীয় সরকার স্বেচ্ছায় আমাদের ভোট প্রদানের ক্ষমতা দিয়ে সহনশীল, উদার ও দরদী মনোভাব দেখিয়েছেন। অথচ আমরা বাঙালি কমিউনিটির প্রতিনিধি নির্বাচনে বাঙালি হয়ে কোন মন-মানসিকতায় আরেক জাতভাইকে ভোটদান থেকে বিরত রাখার জন্য এ ধরনের বিধিমালা তৈরি করি! তবে কি ধরে নেবো এটা কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি? যারা নিজেদের কমিউনিটির কর্তাব্যক্তি মনে করেন, তাদের প্রতি ওইসব অবমূল্যায়িত শিক্ষার্থীর মনোভাব বা ধারণা কেমন হবে তা কি একবারও তারা ভেবে দেখার সময় পেয়েছেন!
আমার জানা মতে, এমন অনেক ছাত্র আছেন যারা বাংলাদেশে লক্ষাধিক টাকা বেতন পেতেন কিন্তু এখানে স্টুডেন্ট স্টেটাসে এসেছেন পিএইচডি করতে। শিক্ষাবর্ষ বা থিসিস শেষ হওয়ার পরই আইরিশ সরকার তাদের প্রথম শ্রেণীর মোটা বেতনের চাকরির অফার দিয়ে এ দেশে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। যাদেরকে আজ স্থায়ী রেসিডেন্সির দোহাই দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, পরবর্তী সময়ে এসব প্রজ্ঞাবান, প্রতিষ্ঠালব্ধ ব্যক্তির কাছ থেকে কমিউনিটি আদৌ কি কোনো আর্থিক, সামাজিক বা জ্ঞানসর্বস্ব কন্ট্রিবিউশন আশা করতে পারবে! তাছাড়া সংগঠন বা কমিউনিটি তো মৌলিক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি অসহায় লোকদের সহযোগিতার জন্যই। আমরা যারা আইরিশ রেসিডেন্সি বা সিটিজেনশিপ নামের সোনার হরিণ হাতে পেয়েছি তাদের তো কোনো সমস্যা নেই। আমাদের যদি কোনো কাজকর্ম নাও থাকে তাহলে বউ-বাচ্চাসহ সবাইকে সরকার যে ভাতা দেবেন তা দিয়ে দিব্যি রাজার হালে চলা যাবে। কিন্তু একজন ছাত্র সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তার যদি কোনো চাকরি-বাকরি না থাকে তাহলে তাকে না খেয়ে কিংবা অর্ধাহারে থাকতে হবে; ব্যর্থ হবে টিউশন ফি দিতে। এক্ষেত্রে কমিউনিটিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু একজন ছাত্রকে যদি আগে থেকেই কোনো অযৌক্তিক অজুহাতে কমিউনিটি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়, তবে সে ছাত্র কোন মুখে ওই কমিউনিটির কাছে এসে সহযোগিতা চাইবে? আর কমিউনিটিই বা কীভাবে তাদের প্রতি সদয় মনোভাব দেখিয়ে দায়িত্ব পালন করবে! কোনো একটি বিশেষ কাউন্টিতে ছাত্রসংখ্যা পুরো আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত রেসিডেন্সিপ্রাপ্ত বাঙালির কয়েক গুণ। ফলে ছাত্রদের ভোটাধিকারের আওতায় আনলে কমিউনিটির সব প্রতিনিধিত্ব ছাত্র বা ওই বিশেষ কাউন্টিতে চলে যাবে-- এ ধরনের ভীতি থেকে যদি ছাত্রদের ভোটাধিকার নষ্ট করার পাঁয়তারা করা হয়, তাহলে তা হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল। এক্ষেত্রে ওই বিশেষ কাউন্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে এ মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, ছাত্ররা যেহেতু স্থায়ী বাসিন্দা নয়, সেহেতু তারা বিশেষ বিশেষ পদগুলোতে নির্বাচন করা থেকে বিরত থাকবেন এবং প্রতিটি কাউন্টি থেকে কোটাভিত্তিক প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার নিয়ম করা যেতে পারে।
সবশেষে বলব, আসুন দ্বন্দ্ব-কলহ, জটিলতা-কুটিলতা বাদ দিয়ে বিশ্ব যেভাবে উদারতান্ত্রিকতার পথে এগোচ্ছে, আমরাও সে পথ অনুসরণ করি। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রোল’ নীতি পরিহার করে, নিজেদের ছোট ছোট স্বার্থগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব আয়ারল্যান্ড’ নামের যে চারাটি এ দেশে রোপিত হয়েছে তাকে পারস্পরিক সম্প্রীতি-শ্রদ্ধাবোধ ও সাংগঠনিক দক্ষতার মাধ্যমে একটি বটগাছে পরিণত করি।
লেখক : আয়ারল্যান্ডপ্রবাসী
ই-মেইল : ংযধলবফ৭০@ুধযড়ড়.পড়স