দশ বছর আগে একটি ওয়াটার পাম্পের বিজ্ঞাপন ছিল এরকম। বাথরুমে গোসল করছেন বাসার গৃহকর্তা।
তিস্তার পানি নিয়ে যখন বাংলাদেশের মানুষ ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করছেন তখন ভারতও আমাদের ঐ ওয়াটার পাম্প কোম্পানির বিজ্ঞাপনের মতো আশ্বস্ত করেছিল ‘পানি নিয়ে ভাবনা আর না আর না’। ‘সবুরে মেওয়া ফলে’র মতো অনেক কথা শুনিয়েছেন। এখনও বলছেন এখন না হলেও তিস্তা চুক্তি হবে। বাংলাদেশের মানুষ আশায় ছিল বন্ধুরাষ্ট্র ভারত আমাদের পানি দেবে। কিন্তু পানি পায়নি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান এর আগে বার বার বলেছিলেন বাংলাদেশ তিস্তায় ৪৪ থেকে ৪৬ শতাংশ পানি পাবে। তারও আগে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সমান সমান পানি পাওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল। শেষ মূহুর্তে বাতিল হওয়া তিস্তা পানি বন্টন চুক্তিতে বাংলাদেশকে ৩৩ শতাংশ হারে পানি দেয়ার প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু বেঁকে বসেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ২৫ শতাংশের বেশি এক শতাংশও বেশি দিতে রাজি না থাকায় পুরো প্রক্রিয়া ভেস্তে গেছে। ফলে তিস্তায় পানির জন্য বাংলাদেশিদের হাহাকার থেকেই গেল। মমতা পশ্চিমবঙ্গের জন্য ৭৫ শতাংশ পানি রেখে দিতে বদ্ধপরিকর। মনমোহনের সফরে বাংলাদেশের মূলত প্রত্যাশাই ছিল তিস্তা চুক্তি। বহুল আলোচিত এ সফরে একটি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব হবে। অবশেষে তা না হওয়ায় পানসে হয়ে গেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরটি।
এই সফরকে স্রেফ ‘শুভেচ্ছা সফর’ বলেও অনেকেই মন্তব্য করছেন। যদিও পররাষ্ট্র সচিব দাবি করেছেন মনমোহনের সফর থেকে প্রাপ্তি উদযাপন করার মতো।
কিন্তু তিস্তা চুক্তি নিয়ে যে বাংলাদেশ বড় ধরণের প্রতারণার শিকার হয়েছে এটা এখন স্পষ্ট। প্রত্যাশা ছিল তিস্তা পাড়ের মানুষ আবার হাসবে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, মনমোহন বাংলাদেশ সফরে আসার আগ থেকেই খুশি ছিল তিস্তা পাড়ের মানুষজন। ৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে যখন তারা সমবেত হয়ে আনন্দ উৎসব করে বাড়ি ফিরছিল, ঠিক সে সময় জানতে পারেন তিস্তা চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। মূহুর্তে আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। তিস্তা পাড়ের মানুষজন বলছেন, এবার তিস্তায় পানি না পেলে তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার দিল্লি ব্যুরো প্রধান জয়ন্ত ঘোষাল বিবিসিকে একপর্যায়ে বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, এ চুক্তি না হওয়ায় ভারত বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাল।
পানিচুক্তি বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি আবেগজড়িত বিষয়। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা ৬ সেপ্টেম্বর জানায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানতেন যে বাংলাদেশকে ২৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ হারে পানি দেয়ার শর্তে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের সঙ্গে মমতার বৈঠকে তিস্তার পানির এ ভাগাভাগিই চূড়ান্ত হয়েছিল বলে আনন্দবাজারের রিপোর্টে দাবি করা হয়।
রিপোর্টে জানানো হয়, ৪ সেপ্টেম্বর মেনন ঝটিকা সফরে ঢাকা ঘুরে যাওয়ার পর মমতা তিস্তা চুক্তির খসড়া কপি পান। তাতে তিনি দেখতে পান বাংলাদেশকে ৩৩ শতাংশ হারে পানি দেয়া হবে। এতে ক্ষুব্ধ মমতা জানতে চান, তাকে না জানিয়ে কীভাবে বাংলাদেশের জন্য পানির অংশ বাড়ানো হলো। মমতা দিল্লিকে জানিয়ে দেন, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে সায় দেবেন তবে কোনোভাবেই ২৫ শতাংশের বেশি পানি দেবেন না।
ভারতের শীর্ষ দৈনিক পত্রিকাগুলো সূত্রে জানা যায়, দিল্লি সরকারের শরিক জোটের অন্যতম দল তৃণমূল কংগ্রেসকে না চটাতে শেষ পর্যন্ত মনমোহন সরকার তিস্তা চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
৬ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার শিরোনাম করেছে, ‘তিস্তায় ডুবলো মমতার সফর’। আনন্দবাজার বলছে, তিস্তা চুক্তি আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মনমোহন ঢাকাকে জানাবেন, অদূর ভবিষ্যতে তিস্তা চুক্তি করতে দিল্লি বদ্ধপরিকর। বাস্তব পরিস্থিতি বুঝিয়ে ঢাকাকে বলা হবে, ‘তাড়াহুড়ো করে অর্ধসিদ্ধ খাবার পরিবেশন না করে একটু অপেক্ষা করে পুরোসিদ্ধ খাবার খাওয়াই ভালো। ’ হিন্দুস্থান টাইমস শিরোনাম করেছে, ‘তিস্তা চুক্তিতে জল ঢেলে দিলেন মমতা’।
মনমোহনের এ সফরে ভারতেরও প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির সমন্বয় যে হয়েছে তা নয়। ভারতের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট সুবিধা পাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ভারতও ট্রানজিট সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সফরে হাসিনা ও মনমোহন কেউ জয়ী না হতে পারলেও জয়ী হয়েছে মমতার জেদ।
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১১