আপনি সেজেগুজে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। যদি সেখানে নিজের প্রতিবিম্ব না দেখে পূর্ব পুরুষের ভেংচি কাটা দেখেন, তবে নিশ্চয় ভাল লাগবে না।
পত্রিকায় দেখলাম হলুদ পোশাক পরা বাচ্চা বয়েসী ছেলেমেয়েরা ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামতেই হাসি হাসি মুখ নিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করছে, ‘স্যার আপনি ট্যাক্স দিয়েছেন তো?’ কেউ কেউ হয়তো জীবনে প্রথম স্যার ডাক শুনে বাক হারিয়ে ফেলতে পারেন। সারা জীবন সরকারি অফিসের মাকড়সা থেকে শুরু করে পিয়ন, দারোয়ান, ছোট সাহেব, মাইজা সাহেব, সাইজা সাহেব, বড় সাহেবকে স্যার ডাকতে ডাকতে কাহিল সেখানে প্রকাশ্য দিবালোকে কিছু তরতাজা তরুণ তরুণীর কন্ঠে সেই সুমধুর ডাক শুনে চোখে শর্ষে ফুল দেখে যে মুর্চ্ছা যায়নি সেটাই বড় কথা।
ছেলেমেয়েদের হলুদ রঙের পোশাক দেখে মনে হয়েছে যথা উদ্দেশ্য তথা পোশাক। মনে পড়ে স্কুলে এক বন্ধু হলুদ জামা আর পাজামা পড়ে স্কুলে এসে কি বিপদেই না পড়েছিল। পরদিন থেকে নামের আগে ‘ডাইরিয়া’ বিশেষণ যুক্ত হয়ে ‘ডাইরিয়া অমুক’ হয়ে গিয়েছিল।
ডাইরিয়া আপাত একটা নিরীহ রোগ মনে হলেও মোটেও তা নয়। ‘যাকে ধরেছে, সে মরেছে’ এ রকম ভয়ঙ্কর না হলেও অনেকটা ছ্যাচড়া টাইপের রোগ। একবার ধরলে বেশ কিছুদিন পিছু ছাড়ে না। মারেও না, রোগটা সারেও না। পানির মতো যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। একদম কাহিল করে ফেলে।
আমরা জনগণ প্রতিদিন ডাইরিয়ার মতো সমাজের কিছু জীবাণুকে প্রতিদিন দিয়েই যাচ্ছি, দিয়েই যাচ্ছি। রাস্তায় নামলে ট্রাফিক পুলিশকে দাও, কোন কাজে সরকারি অফিসে গেলে পিয়ন থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে সকল সাহেবকে দাও। বাড়ি করলে পাড়ার মাস্তানকে দাও। তার আগে বাড়ির নকশার অনুমোদনের জন্য রাজউককে দাও। দেওয়ার কোনও শেষ নেই। যতো দেবে ততো চাইবে। এ যেন ডাইরিয়ার মতো। যতো পেটে পড়ে ততো নীচে সরে।
এতো গেল দিনে দিনে দেবার পালা। বছর শেষে আবার ট্যাক্স দাও। দ্যাশের ভালোর জন্য তো ট্যাক্স দিতেই হবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই যে তার অবস্থা ডাইরিয়া আক্রান্ত রোগীর মতো হয়ে পড়েছে। নিজ প্রাণ বাঁচাতে স্যালাইনটাও হাতে তুলে খাওয়ার শক্তি থাকে না। এরপর কী আর করা। ডাক্তার ডেকে মারো ডাইরেক্ট স্যালাইন। যদি প্রাণ বাঁচানো যায়! ছেলেমেয়েদের দেখে মনে হলো ওরা সামাজিক ডাইরিয়ার প্রতীক হলুদ পোশাকে ধারণ করে জনগণকে ডাইরেক্ট জন সচেতনতার স্যালাইন মারছে যাতে একটু তাজা হয়ে ট্যাক্স দিয়ে দেশটাকে মরণের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। দেশ বাঁচলে তো জনগণ বাঁচবে।
রোগের চিকিৎসা যেমন প্রতিষেধক এবং প্রতিরোধক হতে হয়, না হলে রোগ আবার ফিরে ফিরে আসে। ঠিক তেমনি শুধু ট্যাক্স দিতে উৎসাহিত করলেই চলবে না। যে কারণে মানুষ ট্যাক্স দিতে চায় না সেই কারণগুলোও উদঘাটন করে তার সমাধান দিতে হবে। যেমন ট্যাক্স দেবার প্রক্রিয়াকে আরো সহজতর করা। নাগরিক জীবনে ট্যাক্সের প্রতিফলন থাকা। যারা প্রতিনিয়ত জনগণের টাকা পকেটস্থ করছে তাদেরকে নিবৃত্ত করা। এবং অতি অবশ্যই সমাজের ট্যাক্স উপযোগী ইনকামের সকলকে এর আওতায় আনা। হলুদ পোশাকের কর্মীরা কি এই ঘুষখোরদের দামী গাড়ির টিনটেড কাচ সরিয়ে বলতে পারছে, ‘অনেক তো খেলেন, বছর শেষে দেশটাকে কি দিলেন? দেশের টাকা লুটে খেয়ে তো মোটা হয়েছেন। ব্লাড প্রেসার, হার্ট প্রেসার বেড়ে যাবে তো! এবার দেশকে কিছু দিয়ে ডায়েট কন্ট্রোল করুন। নিজে বাঁচুন, দেশটাকেও বাঁচতে দিন’।
ট্যাক্স নিয়ে জনগণের ভাবনাটা কি হতে পারে সেটা দেখা যাক! পুরো দেশটাইতো একটা বড় পরিবার। ট্যাক্সতো সেই পরিবারের ইনকাম যা দিয়ে তার বছরের সংসার চলবে। কিন্তু সেই ইনকাম যদি পরিবারের বড় ভাই মেরেমুরে শেষ করে দেয় তাহলে আর কাহাতক আর সহ্যের সীমা থাকে! ট্যাক্স ফাঁকি দেবার যাত্রাতো এভাবেই শুরু। সারা বছরই পাড়ার ছিঁচকে মাস্তান থেকে শুরু করে থানার দারোগা সবাইকে ঈদ পার্বণে নতুন জামা থেকে শুরু করে বউয়ের শাড়ি, কোরবানির গরু জনগণের চান্দায় কিনে দেয়া হচ্ছে। তারপরে বছর শেষে ট্যাক্সের নামে পকেট নিঃশেষ করে দিয়ে কি পাচ্ছি আমরা?
প্রশ্নটা খুবই যৌক্তিক। রাস্তার বেহাল দশা, সন্ত্রাস, অনিয়মে ভরপুর দেশটাকে দেখে মনে হয় কে চালাচ্ছে দেশ? আল্লাহর ডাইরেক্ট হেফাজত না থাকলে তো কবেই শেষ হয়ে যেতাম। আয়নায় নিজের সাজুগুজু সুন্দর মুখটার পরিবর্তে বানরের মুখ দেখলে মানুষের যেমন হতাশ হবার কথা, ঠিক তেমনি ট্যাক্সের টাকার কোন প্রতিফলন গণকল্যাণে না দেখলে আয়নায় বানর দেখার মতো জনগণ নিজেকে ট্যাক্স দেওয়া থেকে সরিয়ে নেবে। বানরের ভেংচি যেমন সহ্য হয় না তেমনি ট্যাক্সের টাকা জনগণের পিছনে খরচ না হওয়াটাও সহ্য হবে না।
যাইহোক, গত ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০১১ ‘সবাই মিলে দিব কর, দেশটা হবে স্বনির্ভর’ স্লোগান দিয়ে আয়কর সপ্তাহের উদ্বোধন করলেন উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। দেখবেন, বাস্তবে স্লোগানটা যেন পাল্টে এই না দাঁড়ায়, ‘জনগণে দিলে কর, আমরা হবো মোটা ষাঁড়’। এই মোটা ষাঁড়ের গুঁতোর ভয়ে মানুষ যাতে আবারো দৌঁড় না দেয় সেই ব্যবস্থা করুন।
পুনশ্চ: আয়কর মেলা এবং আনুষঙ্গিক প্রচারের কারণে জনগণ এবার বিপুল পরিমাণে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করতে এগিয়ে এসেছে। এবার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো সিস্টেমের কারণে জনগণ অনেক মহতী কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। জনগণ তাদের ট্যাক্সের টাকা অফিসারদের পকেটে না দেখে জনসেবায় এর প্রতিফলন দেখলে ভবিষ্যতে আরো স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগিয়ে আসবে।
Email: [email protected]
বাংলাদেশ সময় ১১৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১১