উপমহাদেশের নমস্য ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকার, আরসি মজুমদার, নীহাররঞ্জন রায়, দীনেশচন্দ্র সেন, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় এবং আবদুল করিমের মতো পণ্ডিতগণ গবেষণালব্ধ সেই বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। সর্বসাম্প্রতিকতমকালে গোলাম মুরশিদ ‘হাজার বছরের বাঙালি’ এবং মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ নামক গ্রন্থে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের নতুন বিন্যাস রচনা করেছেন।
অথচ ১৭৭৭ সালে রেনেল-এর পূর্বে বাংলাদেশের কোনো মানচিত্র কেউ অঙ্কন করেন নি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জন ম্যাকের নেতৃত্বে বাংলা ভাষায় প্রথম মানচিত্র রচিত হয়। তারও আগে প্রাচীন মিশরীয় টলেমীর মানচিত্রে আবছাভাবে হিমালয় থেকে সমুদ্রস্পর্শী অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে। তখন স্যাটেলাইটের যুগ ছিল না। অতএব সবই কাগজে বিম্বিত প্রতিচিত্র মাত্র। কিছুটা কল্পনা, কিছুটা ধারণার প্রকাশ। বহু বছর পর, ১৯৭১ সালে কারো দিকে না তাকিয়ে বা অপেক্ষা না করেই বাংলাদেশের মানুষ নিজেই স্বদেশের মানচিত্র অঙ্কন করেন। শুধু অঙ্কনই নয়, দামাল যুদ্ধের রক্ত মেখে পৃথিবী উদার আকাশের মুক্ত বাতাসে উড্ডীন করেন স্বাধীনতার রক্তিম পতাকা। আজ মানুষের হাতে হাতে যুদ্ধজয়ে স্মৃতিমাখা অপরাজেয় পতাকা; বিশ্বের সর্বত্র বাংলাদেশের প্রতীকচিহ্ণ হয়ে আকাশ ও দিগন্ত দোলায়িত করছে স্বাধীনতার অমর স্মারকবাহী লাল-সবুজের পতাকা।
জন্মের সময় আমরা আমাদের দেশের নাম দিয়েছিলাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। আদর করে মানুষ যেমন প্রিয়জনকে প্রিয় নামে ডাকে, আমরা আমাদের প্রিয় দেশকে তেমনভাবে ডাকি ‘সোনার বাংলা’। স্বাধীন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক জন্মের প্রায়-শতবর্ষ পূর্বেই বাংলাদেশের মানুষ বাংলা, বাংলাদেশ, সোনার বাংলাকে স্বপ্নে ও সত্ত্বায় ধারণ করেছেন। একটি দেশের স্বপ্ন বাংলাদেশের বাঙালিদের চিত্ত ও মননে সদা-জাগ্রত অনাদীকাল থেকেই। ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্য আরেকটি প্রেক্ষাপটে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বেঁধেছিলেন। দেড়শ’ বছর আগে যখন এই দেশে দখলদার ইংরেজের চাপিয়ে দেওয়া শোষণমূলক নীলচাষের বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষেপে উঠেছিল, তখন ‘নীলবাঁদরে সোনার বাংলা করে ছারখার’ গানটার বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’য় আছে, ‘হ্যা লো সোনার বাংলা খান/পোড়ালে নীল হনুমান’। ফলে এদেশের মানুষের সত্ত্বায় সোনার বাংলার উপস্থিতি ঐতিহাসিক।
ভাষা বা জাতির সঙ্গে দেশ যোগ করে বহু দেশের নাম দেওয়া হয়েছে। আরবদের এরাবিয়া, ইংরেজকে ইংল্যান্ড ইত্যাদির মতো বহুদেশের নামকরণ করা হয়েছে। আমরা বাংলার সঙ্গে দেশ যুক্ত করেছি। রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিচিতিকে স্পষ্ট করেছি। আগেও বাংলা ছিল। আমাদের বাংলাদেশ হলো অতীতের বিকশিত ফসল। যার নামের ছায়ায় একটি স্বাধীন জাতির বাস। একটি সভ্যতার প্রবাহমানতা এবং একটি আস্ত উপ-সাগরের অস্তিত্ব বিরাজমান। নদী ও সমুদ্রস্পর্শী বাংলাদেশের স্থানে স্থানে রয়েছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির আদি বাস্তুভিটা। আমাদের জনপদকে প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসে বর্ণিত গঙ্গারিডি বা গঙ্গাঋদ্ধি চারশ’ বা পাঁচশ’ বছরেরও বেশি স্বাধীন ছিল। মৌর্য, গুপ্ত ও পালদের বাংলা স্বাধীন অস্তিত্ব বজায়ে সচেষ্ট ছিল। ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত বাংলায় স্বাধীন সুলতানি আমল ছিল। বাংলার সোনারগাঁয়ে রাজধানী ছিল। টাকশাল ছিল। অস্ত্রাগার ও সেনানিবাস ছিল। এ সবই গৌরবের কথামালা। স্বাধীনতার ছোঁয়াময়।
কিন্তু অর্জনের উল্টা পিঠেই রয়েছে অনেক কালো দাগ। ইতিহাস তো আসলে আলো ও অন্ধকারেরই খেলা: ভালো আর মন্দের ফলাফলে গৃহীত উপসংহার। ১২০৩ সাল থেকে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির মাধ্যমে যে নবতর বাংলার সূচনা ধরা হয়, সেখানে দাউদ কররানি পর্যন্ত শাসনকালে প্রায় বাহাত্তর জন শাসকের মধ্যে ছাব্বিশ জনেরই অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। চলেছে শক্তির বলে ক্ষমতা দখলের হিড়িক। ‘বাঙালিরা সহজেই হত্যাকারীকে রাজা হিসাবে স্বীকার করে নেয়’ দেখে মুঘল সাম্রারাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে (বাবুরনামা) বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারও বহু শত বছর আগে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের সঙ্গে আগত আমত্য সেলুকাস বলেছিলেন, ‘কী বিচিত্র এই দেশ’! জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনীতে (তুজুক-এ-জাহাঙ্গীরী) বাংলার রহস্যময়তা সম্পর্কে সতর্ক মন্তব্য রয়েছে। এইসব ঐতিহাসিক মন্তব্যকারী ইতিহাসশ্রেষ্ঠ-পুরুষেরা কেউই ভবিষ্যতদ্রষ্টা ছিলেন না। তারা অতীত ও তাদের বর্তমানের অভিজ্ঞতায় কথাগুলো বলেছিলেন। ভবিষ্যতেও যে এমন রাজহত্যা এই জনপদে চলবে, সেটা তারা নিশ্চয় আগাম জানতেন না। (বহু শতাব্দী পরে দুইজন প্রেসিডেন্টসহ রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ে একাধিক সেনাপতি/জেনারেল ও অন্যান্যরাও যে প্রাণ হারাবেন, সেটা নিশ্চয় তৎকালের কেউ জানতেন না। )
ইতিহাসের পাতায় দেখা যাচ্ছে, এদেশে রাজা আসে রাজা যায়। আম-লোকের তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই। খেটে-খাওয়া জনসাধারণ বাঘে-কুমিরের লড়াইয়ে তেমন ঔৎসুক্য দেখায় না। মানুষ শুধু ভয় পায়, তাদের অবস্থা যেন নলখাগড়ার মতো না হয়। সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ পলাশী। পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধের নামে (যুদ্ধ বলতে যা বোঝায়, পলাশীতে তা হয় নি। কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধ-নাটক হয়েছে মাত্র) প্রহসনের কামান-দাগাদাগির পর পাঁচশ’ গোরা পল্টন যখন তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদ পৌঁছে, তখন এত লোক তামাশা দেখতে এসেছিল যে, স্বয়ং ক্লাইভ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হন, ‘প্রত্যেকে একটা ঢিল মারলেই ইংরেজরা খতম হয়ে যেত’।
ক্লাইভ বা কোনো ইংরেজই আঘাত তো দূরঅস্ত, সামান্য ‘ফুলের টোকা’রও সম্মুখীন হয় নি। পৌঁনে দুশ’ বছর পরে যখন ইংরেজরা এদেশের দখল ছেড়ে স্বদেশে চলে যাচ্ছিল, তখনো চারদিকে দাবানলের মতো আগুন জ্বলছিল। দাঙ্গা-হাঙ্গামা-দেশভাগ-বাস্তুচ্যুতি-শরণার্থী সমস্যা-হত্যা-ধর্ষণ সীমাহীন নৈরাজ্য ও রক্তপাতের কারণ ঘটাচ্ছিল। তখন ইংরেজরা তো বটেই, খোদ বড়লাট নমঃনমঃ প্রণাম পাচ্ছিলেন। অ্যালান ক্যাম্বেল জনসন ছিলেন বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের প্রেস সচিব, লিখেছেন, ‘শেষ বিদায়ের সময় বড়লাট বিদায় সংবর্ধনায় ভেসে যাচ্ছিলেন। ’ যদিও তখন দিল্লি, করাচি, লাহোরের পথে পথে মানুষের লাশ, উদ্বাস্তুদের আদিঅন্তহীন নগ্ন পদধ্বনি। কেন ক্লাইভ থেকে মাউন্টব্যাটেন, কেউই বিরোধিতা ও প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হন নি?
কারণ এদেশীয় দালালরা বিদেশি প্রভুদের রক্ষা করেছিল। জনগণের আন্দোলনকে দমন করেছিল। জনগণকে নয়, দালাল নেতৃত্ব বিশ্বাস করেছিল বিদেশাগত প্রভুদেরকেই। বিদেশিদের কোলে নিয়ে চলেছে তারা। জনগণকে দূরে সরিয়ে রেখেছে সব সময়। ইংরেজ শাসনামলের ধারা পাকিস্তানের আমলেও দেখেছি আমরা। নবাব ও রইসরা প্রাসাদে ষড়যন্ত্র করেছে। ইংরেজ আমলে যেমন দিল্লি, পাকিস্তান আমলে তেমনি পিণ্ডিতে মানুষের ভাগ্য বদল করা হয়েছে। মানুষ জানতে পারে নি নিজের ভাগ্য।
১৯৭১ হলো এসবের প্রতিবাদ। স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনটিই হলো প্রকৃতি ও মূলগত অর্থে শত বছরের পরাধীনতা ও দালালির বিরুদ্ধে দীপ্ত বিদ্রোহ; স্বোপার্জিত ভাগ্য বিনির্মাণের রেনেসাঁ। দক্ষিণ এশিয়া ও উপমহাদেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে অন্য কোনো অঞ্চলের খেতের কৃষক, মাঠের চাষী, কলের মজুর, কলেজের ছাত্র, অফিসের কেরানি একজোট হয়ে নিজের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে নি। অস্ত্র হাতে ন্যায়ের যুদ্ধেও লিপ্ত হয় নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন বিশ্বের ইতিহাসে মানবমুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
শাসনের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কহীনতা থাকলে ক্লাইভ আসে যায়; জনগণ অসহায়ের মতো তামাশা দেখতে বাধ্য হয় মাত্র। পরাধীন যুগে জনগণকে হাত-পা বেঁধে রাখা হয়। অংশগ্রহণহীন করা হয়। শুধু তামাশা দেখার অধিকারটুকুই দেওয়া হয়। এ কারণেই ইতিহাসে জনগণের সঙ্গে শাসনের এইরূপ দূরত্ব হেতু বহু বিপর্যয় ঘটেছে। রাষ্ট্রকর্মে ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে জনগণকে বাদ দেওয়া শাসনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ প্রধানত শাসনক্ষেত্র ও জনগণের মধ্যকার হাজার বছরের দূরত্বকে ঘুচিয়ে দিয়েছে। আমার রাষ্ট্র আমিই অর্জন করবো; আমিই শাসন করবো; এমন প্রত্যয় নিয়েই প্রতিটি বীর মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঢাকাকেই করেন রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের কেন্দ্র। এজন্যই জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মহত্তম উদাহরণ হলো বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ। জনগণের রাজনৈতিক অর্জনের সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হলো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ; বাংলাদেশ অমর, অজেয়, জনমানুষের শাশ্বত ঠিকানা।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৭
এমপি/জেডএম