মানুষ সিনেমার নকল অভিনেতার জন্য কাঁদে। বাস্তবতা এখন আর মানবতাকে কাঁদায় না।
সিরিয়ার আগেও পৃথিবী বহু যুদ্ধ দেখেছে। পেরিয়ে এসেছে একাধিক মহাযুদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধে এভাবে এতো বেশি শিশুর মৃত্যুর ঘটনা বিরল, যা এখন হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য নামক ভূখণ্ডে।
সিরিয়ার মতোই বিপদগ্রস্ত ইয়েমেন। ইউনিসেফ জানিয়েছে, ইয়েমেনের এক কোটি ১০ লাখ শিশুর মানবিক সহায়তার প্রয়োজন। ইরাকে সংখ্যাটি কম ছিল না। আর সিরিয়ায় সীমা ছাড়িয়েছে নিহত ও আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের ভাষ্য মতে, বর্তমান সময়ে যুদ্ধ ও সংঘাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মৃত্যু হচ্ছে শিশুদের। অকাতরে মারা পড়ছে শিশুরা। রণাঙ্গনে ও যুদ্ধপ্রান্তরে তৈরি হয়েছে শিশুদের লাশের পাহাড়! সর্বত্র গড়াগড়ি দিচ্ছে শত সহস্র শিশুর রক্তাক্ত মরদেহ।
মিডিয়া প্রতিদিন দেখাচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্য নামক অঞ্চলটির সর্বত্রই মরছে হাজার হাজার শিশু। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে প্রধান বলি হচ্ছে শিশু-কিশোরেরা। সেখানে যুদ্ধে এবং শরণার্থী শিবিরে নিত্য মরছে নাম না জানা সংখ্যাহীন শিশু। বিপন্ন ও অবরুদ্ধ শিবিরে খাদ্যের অভাবেও প্রাণ দিচ্ছে শিশুরা। বোমা ও গোলার আঘাতে একতরফা নিহত হচ্ছে শিশু এবং নারীরা।
জাতিসংঘের একটি অধিবেশনের আলোচনা থেকে জানা গেছে, দায়েশ, তালেবান ও আল-নুসরা ফ্রন্ট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যত শিশু হত্যা করেছে, তা অকল্পনীয়। অন্যদিকে, ইয়েমেনের যুদ্ধপরিস্থিতিতেও হিংসার বলি হচ্ছে অজস্র শিশু।
জাতিসংঘের আলোচনা থেকে শিশুহত্যার যে ভয়াবহ চিত্রটি উঠে আসেনি, তাহলো, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে লড়াইটি এখন মানবতা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও শান্তির প্রতি তীব্র মস্করা হয়ে দাঁড়িয়েছ। শান্তির নাম করে বিভিন্ন পক্ষ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে ‘সুন্দর অস্ত্র’ কিনে তা নিরীহ মানুষের ওপর ব্যবহার করছে। শান্তি ও মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলে জড়িতরা নিজেদের চেহারা গোপন রাখলেও তাদের বীভৎস তৎপরতা স্পষ্ট হয়েছে। কারণ তাদের হাতেও মারা পড়ছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা।
লাগাতার সংঘাত ও যুদ্ধের আগুনে যখন পুড়ছে মধ্যপ্রাচ্য ও মূলত মরছে শিশুরা, তখন দুটি ভিন্ন ধরনের চিত্র দেখতে পাওয়া গেছে সিরিয়া ও ইয়েমেনে।
সিরিয়ায় দেখা গেছে, একতরফা হামলায় অবোঝ শিশুরা মরছে। অন্যদিকে ইয়েমেনে শিশুদের হাতে জোর করে অস্ত্র তুলে দিয়ে পাঠানো হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ইয়েমেনে যোদ্ধাদের এক তৃতীয়াংশই শিশু! এই শিশু-সৈনিকরা দারিদ্র্যের কারণে যুদ্ধে যাচ্ছে এমনটি নয়, যাচ্ছে বাধ্য হয়ে। শিশুযোদ্ধারা তাদের বাবা-মা, অভিভাবক এবং রাজনীতিবিদদের ক্রীড়নক হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, শিশুদের যুদ্ধে পাঠানোর কারণে অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটি উদাহরণে দেখানো হয়েছে যে, মাত্র ১৭ বছরের সাঈদও যুদ্ধের পোশাক পরিধান করেছে। সাঈদ বলেছে, ‘সাহসী সে-ই, যে যুদ্ধের ময়দানে বীরের মতো লড়তে পারে, শহীদ হয়। বীরেরা শত্রুকে মারে ও মরে আর ভীরুরা মরে নিজের ঘরে। ’
আরেকটি উদাহরণে ১৫ বছর বয়সী স্কুলছাত্র আহমেদ স্কুলের ক্লাসরুমের চেয়ে যুদ্ধের ময়দানকে বেছে নিয়েছে, কলম ছেড়ে অস্ত্র হাতে নিয়েছে, পাঠ্যপুস্তক ছেড়ে সেনাদের প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছে।
এসব উদাহরণ বিচ্ছিন্ন নয়। কারণ সাঈদের বড় ভাই আহমেদের বয়স ৩৮ এবং খালিদের বয়স ৩৬। তারাও পড়াশনা শেষ না করেই ১৭ বছর আগে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সাহসী বীর পুরুষদের দায়িত্বই হচ্ছে জাতির মুক্তির জন্য লড়ে যাওয়া।
রাজনীতিবিদগণ এভাবেই মানুষকে, এমনকি শিশুদের যুদ্ধমুখী করেছে। সাঈদের বাবা মুরাদের মতে, যুদ্ধের সময় দেশ-জাতিকে রক্ষার দায়িত্ব, তখন ক্যারিয়ার-পড়াশুনা নিয়ে ভাবার সময় নয়।
তিনি বলেন, বয়স যুদ্ধে যাবার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নয় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাহসী হৃদয়। যার মনে সাহস আছে সে আমার ছেলের মতোই যুদ্ধে যেতে পারে।
যুদ্ধের তীব্র উন্মাদনা নানাভাবে ছড়িয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। অনেক অভিভাবকই বলেন, আমি আমার ছেলেদের যেমন যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করি, তেমনি গ্রামের অন্য কিশোর-তরুণ-যুবকদেরও যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করি। আমি কাউকে শিশু বলে ছাড় দিতে রাজি নই।
বনি সাবাই এলাকার আল-ফাজ স্কুলের শিক্ষক জামাল আইদারোস 'মিডেল ইস্ট আই'কে জানান, আমি যখন সেনাক্যাম্পে প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিলাম, আমি আমার ২ জন সাবেক শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ নিতে দেখলাম। তারা যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য আমার চেয়েও বেশি দ্ক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল।
অনেক পর্যবেক্ষকই সরেজমিনে দেখতে পেয়েছেন যে, শিশুযোদ্ধা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক এলাকার সাধারণ ঘটনা। তারা যুদ্ধ করছে, কাজ করছে বিভিন্ন চেক পয়েন্টে। তাদের অধিকাংশই গরিব পরিবার থেকে এসেছে। তাদের আর্থিক চাহিদাও তাদেরকে এই দিকে ঠেলে দেয়। অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের বলপূর্বক যুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছে টাকার জন্য, এমন উদাহরণও আছে।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের নানা রণাঙ্গনে সক্রিয় বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গ্রুপ হত্যা ছাড়াও জোরপূর্বক বালক-বালিকাদের তুলে নিচ্ছে। অপহৃতদের দিয়ে নানা ধরনের যুদ্ধ-সহায়ক কাজসহ তাদেরকে বর্বর পন্থায় যৌন নিপীড়ন করা হচ্ছে। যৌন সম্ভোগ করতে দিলে তাদেরকে খাবার ও আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত ও যুদ্ধে গত দুই বছরে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে পঞ্চাশ হাজারের বেশি শিশু রয়েছে বলে বেসরকারি সূত্রগুলো দাবি করেছে। আর যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে লক্ষাধিক বালক-বালিকা। পিতামাতা ও অভিভাবক যখন যুদ্ধের কারণে নিহত বা নিখোঁজ হয়, তখন হতভাগ্য শিশুদের পরিস্থিতির নির্মম বলি হতে হচ্ছে।
একটি আশঙ্কাজনক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শিশুদের মধ্যে ২৫ হাজার জন্মের পরপরই এবং জন্মের ৯ মাসের মাথায় মারা গেছে। সেখানে প্রায় কমপক্ষে ৩০ লাখ মানুষকে সম্পূর্ণভাবে খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ৪ লাখ শিশু ভুগছে মারাত্মক অপুষ্টিতে। কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ১০ লাখ।
ইউনিসেফ জানিয়েছে, শুধু ইয়েমেনেরই এক কোটি ১০ লাখ শিশুর মানবিক সহায়তার প্রয়োজন। সিরিয়ায় যে সংখ্যা কয়েক গুণ।
যুদ্ধের ভয়াবহ দাবানলের কবল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ, বিশেষত শিশুরা, কখন রক্ষা পাবে কেউ জানে না!
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৮
জেএম