ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

তিউনিশিয়ার জাতীয় নির্বাচনে জনপ্রিয় ব্লগাররা

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১১
তিউনিশিয়ার জাতীয় নির্বাচনে জনপ্রিয় ব্লগাররা

তিউনিশিয়ার জনপ্রিয় প্রভাবশালী ব্লগাররা সে দেশের ঐতিহাসিক নির্বাচনে অংশ নেন। ‘আরব বসন্তের’ পর রোববার দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্লগারদের এক সম্মেলন হয়। ব্লগাররা সেখানে দেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক কাঠামো সম্পর্কে নিজেদের চিন্তাভাবনা বিনিময় ও নির্বাচনে কী করে জনমত নিজেদের পক্ষে নেওয়া যায়, এসব বিষয়ে মতামত দেন।

উল্লেখ্য, আরব বসন্তের শুরু তিউনিশিয়ায়। এরপর সেটি মিশর, জর্দান, ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়া, বাহরাইন, সৌদি আরবে ছড়িয়ে পড়ে। তিউনিশিয়ার পর আরব জনতা বিজয়ী হয় মিশরে। লৌহমানব গাদ্দাফির করুণ মৃত্যুর মাধ্যমে ‘জনতা’ সর্বশেষ বিজয়ী হয়েছে লিবিয়ায়। ইয়েমেনের বিজয় দ্বারপ্রান্তে। মনে করা হচ্ছে, আরব বসন্তের পরবর্তী টার্গেট সিরিয়া। এই বসন্ত স্বপ্নের সঙ্গে আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনীও জড়িয়ে যাচ্ছে! এদের আনুকূল্য পাওয়াতে জর্দান, বাহরাইন, সৌদি আরবের শাসকরা পরিস্থিতি আপাতত সামাল দিতে পেরেছেন।

আরব বসন্তের পথিকৃতেরর মর্যাদা পেয়েছেন তিউনিশিয়ার ব্লগাররা। এদের সিংহভাগ আবার নারী। স্বৈরশাসক-একনায়ক নিয়ন্ত্রিত দেশগুলোয় কড়া সেন্সরশিপের ভেতরে থেকেও এরা ব্লগ, ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যমগুলোয় আগুন ছড়িয়ে দেয়া শিখিয়েছেন। সে আগুন ছড়িয়ে গেছে মিশরসহ গোটা আরব জাহানে। সাইবার সেন্সরশিপের মধ্যে থেকে নানা ঝুঁকি, ঘাতপ্রতিঘাত মোকাবেলা করে ব্লগের মাধ্যমে জনমত সংগঠনের মাধ্যমে কাজ তারা করেছেন। স্বৈরাচারের গোপন পুলিশ তাদের ইন্টারনেট সংযোগে বারবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। হ্যাকড হয়েছে ব্লগ ওয়েবসাইট। গোপন পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের শারীরিক নির্যাতন করেছে। জেলে পুরেছে। কিন্তু দমাতে পারেনি। সপরিবারে সৌদি আরব পালিয়ে গেছে তিউনিশিয়ার স্বৈরাচারী একনায়ক বেন আলী। দুনিয়ার সব দুর্নীতিবাজ একনায়কের সেটি যেন স্বর্গ!

তিউনিশিয়া বিপ্লবের হৈ চৈ ফেলে দেয়া ‘আ তিউনেশিয়াল গার্ল’ ব্লগকে এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। লিনা বেন মেহন্নি এর ব্লগার। তার অনুসারী ব্লগার সেলিম আমানাওকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী করেছে বিপ্লব পরবর্তী সরকার । কিন্তু ব্লগারদের সম্মেলনে সতর্ক করে বলা হয়েছে তিউনিশিয়ার অন্তর্বর্তী শাসকরা নারী পুরুষের সমান মর্যাদার কাজ প্রতিশ্রুতি মতো করছে না। পুলিশি সন্ত্রাস, দুর্নীতি সেই আগের মতোই চলছে। এমন চললে ধুলিস্মাৎ হয়ে যাবে বিপ্লবের স্বপ্ন।

ব্লগার রিয়াদ গোয়েরফালি পেশায় একজন আইনজীবী। এক সময় দক্ষিণ ফ্রান্সের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। বিপ্লবের সময় তার ‘নাওয়াত’ ব্লগটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়। স্বৈরশাসক বেন আলীর কঠোর সেন্সরশিপের মধ্যে ২০০৪ সালে সৃষ্টি হয় নাওয়াত ব্লগটির। নানা বিধিনিষেধের মধ্যে কৌশলের লেখা লিখতেন রিয়াদ। এরপরও তাকে হয়রানি কম পোহাতে হয়নি। বিপ্লব শুরুর পর রিয়াদ বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দেশের মানুষকে তথ্য, অনুপ্রেরণা দিয়েছে তার ব্লগ। উত্তর তিউনিশিয়ার বন্দর শহর বিজেরতি থেকে রিয়াদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

সাতাশ বছর বয়সী ব্লগার আমিরা ইয়াই’ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে লড়ছেন নির্বাচনে । তার  ব্লগের নাম সাওত মসতাকেল। এর অর্থ স্বাধীনতার কন্ঠস্বর। ১৮ বছর বয়সে ব্লগিং শুরু করেন আমিরা। স্বৈরাচারী বেন আলীর গোপন পুলিশ এর কারণে তাকে নানাভাবে হয়রানি করেছে। ১৭ বছর বয়সে পুলিশের নির্যাতনে তার একটি পা ভেঙে যায়। এসব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ২০১০ সালের মে মাসে সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। সাইবার অ্যাক্টিভিস্টরা তার প্রতিবাদে শাণিত হয়। তার টুইটার আইডি @mira404. স্বৈরাচারের গোপন পুলিশ তার ওয়েবপেজটি ব্লক করে দিলে “404-page not found” নোটিসটি সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে।

মূলত ব্লগের মাধ্যমেই চলে আমিরার নির্বাচনী প্রচারণা। অনুসারী সমর্থকদের উদ্দেশে লিখেছেন, আগে আমরা স্বৈরাচারী একটি ব্যবস্থাকে ধবংস করতে চেয়েছি। এখন আমরা শুরু করতে চলেছি গণতান্ত্রিক কাঠামোর নির্মাণ। নির্বাচনের পর দেশের নতুন সংবিধান রচনা হবে। সে কারণেই নির্বাচনটি তিউনিশিয়ার ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মারিয়ার বাবা মক্তার ইয়াহই ছিলেন পেশায় বিচারক। স্বৈরাচারের দুর্নীতি, বিচারের নামে প্রহসনের প্রতিবাদ করার তাকে পদচ্যুত ও বিচারের মুখোমুখি করা হয়। মক্তার ইয়াহই ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

ব্লগার ইয়াসিন আয়ারির বয়স ৩০। পেশায় কম্পিউটার প্রকৌশলী। তার স্লিম আমামউ ব্লগটি ২০১০ সালের মে মাসে স্বৈরাচারের পুলিশ বন্ধ করে দেয়। কিন্ত তার কৌশলি ব্লগিং বন্ধ থাকেনি। সেই ইয়াসিন উত্তর তিউনিশিয়ার একটি আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে লড়েন। তার নির্বাচনী স্লোগান মুক্ত তারুণ্য। এ ব্যাপারে ইয়াসিনের বক্তব্য, প্রচলিত  রাজনৈতিক দলগুলো যাদের প্রার্থী করেছে তাদের বেশিরভাগের বয়স ষাটের বেশি। দেশের তরুণরা কী পরিবর্তনের আশায় আন্দোলন করেছে এরা তা জানে না, বোঝে না। মানুষ চায় এসব রাজনীতিকরা কথাবার্তা বন্ধ করে আগে তাদের কথা শুনুক। কিন্তু তারা তা শুনছে না। এদের দিয়ে পরিবর্তন সম্ভব না।   সে কারণেই তরুণ সমাজের অনুরোধে প্রার্থী হয়েছেন। আন্দোলনের দিনগুলোর মত তরুণরাই তার নির্বাচনের কাজ করেন।

বেন আলী বিরোধী আন্দোলনে পিঙ্ক লেমন নামের ব্লগ বিশেষ সাড়া ফেলেছিল। এর ব্লগার মেহেদি লেমন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে জড়িত। স্বতন্ত্র প্রার্থী দার্শনিক, নৃ্তত্ত্ববিদ ইউসুফ সাদিকের জন্য কাজ করছেন মেহেদি। তার বক্তব্য আমরা যে পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন করেছি, ইউসুফের মতো প্রার্থীরা জিতলেই সে লক্ষ্য হাসিলের কাজ এগিয়ে নেয়া সম্ভব। জনপ্রিয় ব্লগার, টুইটারের @t_kahlaoui আইডির তারেক কাহলাওইও ছিলেন নির্বাচনে স্বতন্ত্রী প্রার্থী। পরিবেশবাদী তরুণ ব্লগার ইমেন ব্রাহাম স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্লগার আমিরার পক্ষে কাজ করেন। ব্রাহাম তার ব্লগে লিখেছেন, তিউনিশিয়ার তরুণ সমাজ একটি প্রকৃত পরিবর্তনের অপেক্ষায়। তারা কাজ চায়। আর চায় দুর্নীতির অবসান। নির্বাচন পরিবর্তনের পক্ষে একটি পদক্ষেপ মাত্র। কিন্তু ব্রাহামের আশংকা যে পরিমাণ মানুষ আন্দোলনে এসেছে সে পরিমাণ হয়ত ভোট আসবে না। কারণ স্বৈরাচারের দীর্ঘ দুইযুগ শাসনে স্বাধীন ভোট চর্চার অভ্যাস গড়েনি। আন্দোলন বিজয়ী তিউনিশিয়ার ব্লগারদের এভাবে সরাসরি দেশের জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি দুনিয়াজুড়ে মিডিয়ার মানুষজন, বিশেষ করে ব্লগারদের মধ্যে ঔৎসুক্য চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad