ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কোরবানি, শ্রীবর্দীর মসজিদের ইমাম ও শেরপুরের সাংবাদিক মনিরুল

ফজলুল বারী, কন্ট্র্রিবউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১১
কোরবানি, শ্রীবর্দীর মসজিদের ইমাম ও শেরপুরের সাংবাদিক মনিরুল

কোরবানির ঈদ সামনে। মিডিয়ায় শুরু হবে ডেইলি কোরবানি এ্যাসাইনমেন্ট!কুরবানির পশুর হাট, চাঁদাবাজি, সবচেয়ে দামি গো’ সেলিব্রেটির দাম নিয়ে মুখরোচক খবর-ছবি, হাট থেকে বেয়াড়া গরুর দড়ি হাতে অনভ্যস্ত ঘরে ফিরতে ফিরতে ‘ভাই দাম কত পড়েছে’ প্রশ্নের  জবাব দিতে দিতে পেরেশান সৌখিন শহুরে রাখাল যুবকের বৃত্তান্ত! পাড়াময় হাঁটতে হাঁটতে বা মোবাইলে একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাসা, আপনি গরু না ছাগল, এমন নানান কিছুতে কোরবানি নিয়ে আগামি কিছুদিন সরগরম থাকবে বাংলাদেশের বাঙ্গালি মুসলিম আর মিডিয়া জীবন!

মিডিয়া আর কীভাবে কোরবানি ঈদ-কালচারের সঙ্গে সমৃক্ত হতে পারে? একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যাক।

একবার কুরবানির ঈদের আগে ঢাকার বাইরের প্রত্যন্ত এলাকার এক মসজিদের ইমাম সাহেবের পাঠানো চিঠিতে চোখ আটকায়। স্পর্শ করে। শেরপুরের শ্রীবর্দী উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামের এক মসজিদের ইমাম তার চিঠিতে লিখেন তার এলাকাটি খুব গরিব। গ্রামের লোকজনের কোরবানি দেবার সামর্থ নেই। সে কারনে আগের ঈদে সে গ্রামে কোন কোরবানি হয়নি। কোরবানির সূত্রে সাধারনত গ্রামের গরিব লোকজন মূলত বছরে এই ঈদের দিনটিতেই একবার মাংস খান। কিন্তু গ্রামে কোন কোরবানি না হওয়াতে তাদের সেই বার্ষিক একবার মাংস খাওয়াটিও আর বরাতে জোটেনি।

ইমাম সাহেবের সেই চিঠিই নিয়ে নিয়ে মানবিক একটি রিপোর্টি তৈরি করলে তা গুরুত্ব দিয়ে ছাপাও হয়। কিন্তু রিপোর্ট ছাপার দিন পত্রিকার ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়াতে সৃষ্টি হয় আরেক জটিলতার! রিপোর্ট পড়ে নিজেদের কোরবানির গরুর টাকা নিয়ে অফিসে চলে আসে তিনটি পরিবার। সঙ্গে টাকাগুলো সে গ্রামের ইমাম সাহেবের হাতে পৌঁছে  দেবার কাতর অনুরোধ। অফিস বন্ধ। কোন রিপোর্টার আসবেনা বলে প্রহরী তাদের নির্বৃত্ত করতে পারেন না। অফিসের কাছে বাসা। ঠিকানা নিয়ে বাসায় চলে আসেন সেই তিন পরিবারের সদস্যিরা। অতঃপর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে তাদের টাকা রিসিভ করতে হয়েছে।

পত্রিকার শেরপুর জেলার নিজস্ব সংবাদদাতা মনিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করতে হয় পরবর্তি কার্যক্রম। পরিকল্পনা অনুসারে ফুলবাড়িয়ার বাস টার্মিনালে গিয়ে শেরপুরগামী বিআরটিসি’র বাস ড্রাইভারের হাতে টাকাগুলো তুলে দেয়া হয়। বাসটি শেরপুর পৌঁছার পর তার থেকে টাকাগুলো বুঝে নেন স্থানীয় সাংবাদিক মনিরুল। এরপর তিনি টাকাগুলো নিয়ে শ্রীবর্দী উপজেলার প্রত্যন্ত সে গ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা হন। গ্রামে পৌঁছে মসজিদের ইমাম আর গ্রামের দু’জন মুরব্বিকে নিয়ে চলে যান গরু কেনার হাটে। সেখানে ওই টাকার মধ্যে ইমাম-মুরব্বিরা মিলে তিনটা গরু কিনেন। এরপর সেখান থেকে খুশি খুশি ইমাম-মুরব্বিদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন স্থানীয় সাংবাদিক। এরপর কোরবানির মালিক সেই তিন পরিবারের সঙ্গেও তাদের কথা বলিয়ে দেয়া হয়।

ঈদের দিন ভোরে মনিরুল আবার যান সেই গ্রামে। ঈদের নামাজের পর ঈদগাহ’র পাশেই  সেই তিন পরিবারের নামে কোরবানি হয়। এর আগে ঈদের জামাতে গ্রামে বিশেষ ধরনের কোরবানির ঘোষণা দিয়ে দাতা পরিবার তিনটির জন্য মুনাজাত করা হয়। মাংস কেটে সেগুলো গ্রামের দু’শ পরিবারের জন্য সমান দু’শ ভাগ-প্যাকেট করা হয় সে মাংসের। দু’শ পরিবারের সদস্যরা স্মরনীয় ঈদের মাংস নিয়ে যার যার বাড়ি ফিরে যান। ঈদের দিনও মাংস খেতে না পারার তাদের আক্ষেপও যায়।

ঈদের ছুটির পর প্রকাশিত প্রথম দিনের পত্রিকায় শ্রীবর্দী সেই গ্রামের কোরবানির বৃত্তান্ত ছাপা হয়েছে। কিন্তু দাতা পরিবার তিনটির অনুরোধে রিপোর্টে তাদের নাম-পরিচয় ছাপা হয়নি। বাংলাদেশের দাতা শ্রেনীর লোকজন এভাবে ভিতর থেকেই বদলে যাচ্ছেন। দানের বিনিময়ে তারা প্রচার চান না। দানের মাধ্যমে নিরবে খোদার তুষ্টি চান। রিপোর্ট ছাপার পর অনেক পাঠক যোগাযোগ করে জানান পুরো বিষয়টি তাদের অন্তর ছুঁয়েছে। অনেকে অনুরোধ করে বলেন পরবর্তি ঈদে যেন এমন কোরবানির সুযোগ তাদেরও দেয়া হয়।

আত্মত্যাগের কোরবানির বিষয়টি আমাদের কিছু লোকজনের কাছে সামাজিকতারও। কে গরু না খাসি, কার গরুর দাম কত এসব নিয়ে একধরনের প্রতিযোগিতাও হয়। অনেকে আবার ঢাকা বা প্রধান শহরগুলোর বাসাবাড়িতে এবং গ্রামের বাড়িতে আলাদা করে কোরবানি দেন। শেরপুরের গ্রামের ওই ঘটনার মতো প্রত্যন্ত আরও দরিদ্র-অনগ্রসর এলাকার গল্প আছে সারাদেশে। যাদের কোরবানির আয়োজন, জবাই-মাংস বিলিবন্টনের লোকবলের সমস্যা আছে তারা কিন্তু শেরপুরের ঘটনাটির মতো গ্রামে দরিদ্র মানুষজনের মধ্যে কুরবানির উদ্যোগ নিতে পারেন। এক্ষেত্রে শেরপুরের মনিরুল ইসলামের মতো আন্তরিক পরিশ্রমী সংবাদ কর্মীদের কাজে লাগিয়ে সংগঠকের ভূমিকা পালন করতে পারে মিডিয়া। সুযোগটি কী নেবেন দয়ালু মানুষ? শান্তি পাবেন মনে। অবিশ্বাস্য সেই শান্তির আনন্দ।

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় ১০৩৩ ঘন্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।