একইসাথে সরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদেরও ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে শতভাগ বৃদ্ধি পেয়ে সর্বনিম্ন গ্রেডের ন্যূনতম মজুরি ৮৩০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ গ্রেডের ন্যূনতম মজুরি ১১,২০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই সাথে তারা নববর্ষ ভাতা হিসেবে নতুন একটি ভাতার সুযোগও পাচ্ছেন।
এমনিতে রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প শ্রমিকরা পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, যেসবের অধিকার গার্মেন্ট শ্রমিকদের নেই। রাষ্ট্রায়ত্ব এবং বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা মানবিক জীবন-যাপন এবং মর্যাদার উপযোগী বেতন কাঠামোর ন্যায্য দাবিদার। ফলে এখানে কোনো প্রতিহিংসামূলক তুলনা করা হচ্ছে না। বরং, একটু বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলেও সরকারি শ্রমিকদেরও যে মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে সেখানেও শ্রমিককে ন্যূনতম মানুষ বিবেচনা করা হয়নি। তুলনাটা এ কারণে করা, যে গার্মেন্ট খাতের শ্রমিকদের শ্রমে-ঘামে দেশের অর্থনীতির ভিত দাঁড়িয়ে আছে, তাদের এমনকি রাষ্টায়ত্ব শিল্প-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির যেসব বিবেচনা, তার মধ্যেও রাখা হয়নি।
মাস ছয় ধরে কিংবা তারও আগে থেকেই তৈরি পোশাকখাতে বেতন বৃদ্ধির গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। প্রথমে ঘোষণা এলো ন্যূনতম মজুরি ৬৩০০ টাকার। শ্রমিকরা মানতে নারাজ। বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিকরা সভা-সমাবেশ করে এই মজুরি প্রত্যাখ্যান করেছিল। এরপর ঘোষণা এলো ৮০০০ টাকার। এখনো শ্রমিকরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু খুব বড় আকারের শ্রমিকদের ঢল নামেনি এখনো। কারণ ২০১৬ সালের মজুরি আন্দোলনের পর যে অভিঘাত শ্রমিকদের সইতে হয়েছিলো তা এখনো শ্রমিকরা ভুলেননি। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের গণহারে ছাঁটাই করা হয়েছে, তাদের নামে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছেন অনেকে। এক কারখানা থেকে চাকরি হারিয়ে অন্য কারখানায় চাকরিও জুটছিলো না। শিল্প এলাকার কারখানাগুলোর দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছিলো মামলাপ্রাপ্ত-চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের ছবি। যেন এরা খুন করা দাগী আসামি। অনেকেই ফেরার হয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন গ্রেফতার এড়াতে, কি নারী-কি পুরুষ শ্রমিক। বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ রেইড করেছে মামলাপ্রাপ্ত শ্রমিক নারী-পুরুষদের গ্রেফতার করতে।
আশুলিয়ার শ্রমিকদের সাথে কথা বললেই ২০১৬ সালের মজুরি আন্দোলন সবার মুখে মুখে ফিরে ফিরে আসে। ১০-১২ দিন টানা কারখানায় কাজ বন্ধ রেখেছিলেন শ্রমিকেরা পোশাকখাতে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে। তার অভিঘাত এখনো সইতে হচ্ছে। শ্রমিকদের শিক্ষা দিতে কারখানার অনেক সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে ফেলা হয়েছে। আগে অনেক কারখানায় দুপুরের খাবার দেওয়া হতো, পরিবহন সুবিধা ছিলো। এখন সেসব বাদ দেওয়া হয়েছে। আগে একজন সিউয়িং অপারেটর এর সাথে হেল্পার থাকতো, এখন বেশিরভাগ কারখানায় হেল্পার নেই বললেই চলে। অপারেটরকেই হেল্পার আর অপারেটরের কাজ একাই করতে হয়। প্রডাকশন টার্গেট বেড়েছে, বাড়ছে দিন দিন। শ্রমিকরা বলছেন ষোলো সালের পর থেকে শ্রমিকদের কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেক বেড়েছে। আগে প্রডাকশন লাইনে বসে ক্ষিদে পেলে অপ্ল-বিস্তর খাওয়া যেতো। আর এখন লাঞ্চের সময় ছাড়া একফোঁটা পানিও খাওয়া যায় না।
সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর ন্যায়বিচার; এটা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। কিন্তু সাতচল্লিশ বছরের স্বাধীন দেশে সাম্য প্রতিষ্ঠা দূরের কথা, ন্যায্যতার দাবি তোলার গণতান্ত্রিক অধিকার আর পরিবেশটুকুও আমরা পাইনি। শ্রমিককে কেন মাঠে নেমে, রোদে পুড়ে, পুলিশের লাঠি-ঠ্যাঙ্গানি, গুলি, টিয়ারশেল আর হামলা-মামলা খেয়ে দাবি তুলতে হবে? কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন থাকবে, যার প্রতিনিধিরা সুস্থ-গণতান্ত্রিক পরিবেশে মালিক প্রতিনিধিদের সাথে দর-কষাকষি করবে। দেশে সাম্যের অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুনি-দেখি, দেশে নাকি মুক্তবাজার অর্থনীতি চলে। সেই অর্থনীতির দার্শনিক মন্ত্রেও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের দরকষাকষির সক্ষমতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অবশ্য মুক্তবাজার অর্থনীতিতেও দরকষাকষির সক্ষমতা অন্য আরও অনেক ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। শ্রমিক সেইসব ক্ষমতায় পিছিয়ে। তবে বিদ্যমান সামষ্টিক উৎপাদন সম্পর্কে শ্রমিকের একমাত্র ক্ষমতা তাদের একতাবদ্ধতায়। তাই বোধ করি ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারে মালিক পক্ষের এত ভয়। কিন্তু এই অতি আশংকা থেকে ক্রমাগতই কারখানায় শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক সহিংস হয়ে উঠছে। বরং, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার কারখানারা পরিবেশ আরও গণতান্ত্রিক করতে পারতো, ফলশ্রুতিতে বাড়তে পারতো উৎপাদনশীলতার হারও। ‘কারখানার কোন বিষয়টা শ্রমিকদের বেশি আহত করে’, অনেক শ্রমিকের সাথেই কথোপকথনে উত্তর মিলেছে, ‘অশালীন বকাঝকা। একটু ভাল ব্যবহার করলে চাপ পড়লেও কাজ করতে মনে কোনো খেদ থাকে না। কিন্তু, যখন বাপ-মা তুইলা গালি দেয়, তখন মনে হয়, কাজ-কাম থুইয়া কোথাও পালাইয়া যাই। ’
শ্রমিকদের ভাষ্য অনুযায়ী মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা সবেমাত্র এসেছে, কিন্তু এর মধ্যেই বর্ধিত মজুরির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কারখানাগুলোতে নানা অজুহাতে চলছে শ্রমিক ছাঁটাই। বিশেষ করে ছাঁটাই করা হচ্ছে হেল্পারদের। এরপরে কারখানায় হেল্পার বলে আর কোনো পদ থাকবে না। মজুরি কিছুটা বাড়ছে সত্য, কিন্তু এখন একজন শ্রমিককে একসাথে অনেক কাজ করতে হবে। বাড়ানো হচ্ছে প্রডাকশন টার্গেটও। আগে যেখানে ঘণ্টাপ্রতি প্রডাকশন টার্গেট ৮০-১০০ পিস ছিলো, এখন ঘণ্টাপ্রতি ১০০-১২০ পিস টার্গেট পূরণ করতে বলা হচ্ছে। তারপরও শ্রমিকরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ, আর কোনো উপায় নাই। বিশেষত গরিব নারী শ্রমিকদের জন্য গার্মেন্টে কাজ করা ছাড়া আর বড় কী বিকল্প কর্মসংস্থান আছে?!
পাঁচ বছর পর গার্মেন্ট শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা হলো ৮০০০ টাকা। শ্রমিকদের দাবি ছিলো ন্যূনতম মোট মজুরি ১৬,০০০ টাকা নির্ধারণ করার। এতদিন শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি ৫৩০০ টাকা দিয়ে জীবন চালিয়েছেন। ঢাকা শহরে এই টাকায় একটা পরিবার কিভাবে চলে, চলার কথা আমরা ভাবি, এটা রীতিমতো বিস্ময়কর। তারপরও শ্রমিকের জীবন চলেছে, চালাতে হয়েছে। এক ঘরে পাঁচজন সাতজন থেকে, খাদ্য তালিকায় আমিষের পরিমাণ কমিয়ে, বাড়ি থেকে নাবালক ভাই-বোন-ছেলে-মেয়েদের এনে কাজে লাগিয়ে। এরা কেউ কেউ বারো-তেরো বছর বয়সেই শ্রমিক হয়েছে ভোটার আইডি কার্ডে বয়স বাড়িয়ে। যার বয়স এখন পনেরোও হয়নি আইনি কাগজে তার বয়স বিশ হয়ে গেছে!
বাংলাদেশে গার্মেন্ট খাতের শ্রমিকদের সিংহভাগই নারী। কাগজে-কলমে লিখিত না থাকলেও, পুরুষতান্ত্রিক ভাবনায় নারীকে ‘সেকেন্ডারি আর্নার’ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এর ফলে দেখি, নারী যে খাতেই শ্রমিক হিসেবে যুক্ত হন তার মজুরি তুলনামূলক কম হয়। বিশ্বব্যাপী এটি একটি সাধারণ বিষয়। বাংলাদেশেও গার্মেন্ট শিল্পে অধিক হারে নারী শ্রমিক নিয়োগের প্রধান কারণ সস্তা এবং সহজলভ্য নারীশ্রম। কিন্তু ‘সেকেন্ডারী আর্নার’ বলে তো নারীকে আধাবেলা খাটানো হচ্ছে না। বরং নারীরা সহজে কর্তৃপক্ষের বশে থাকে বলে তাদের দিয়ে বেশিই খাটিয়ে নেওয়া যায়। আর নারীরা দক্ষতার সাথেই গার্মেন্ট উৎপাদন চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে, এই খাতের পুঁজি-মুনাফার উত্তরোত্তর প্রবৃদ্ধিই এর প্রমাণ। ফলে শুধুমাত্র মানবিক জীবন-যাপনের বিবেচনার দিক থেকে নয়, গার্মেন্ট খাতে একজন শ্রমিক যে পরিমাণ পরিশ্রম করেন সেই বিবেচনায়ও আট হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি ন্যায্য হতে পারে না। আর নারীরা পরিবারের ‘সেকেন্ডারী আর্নার’, আজকের দিনে এই যুক্তি ধোপে টেকে না। অনেক পরিবারই আছে স্বামী-স্ত্রী দুইজনের উপার্জন ছাড়া চলার মতো বাস্তব অবস্থায়ই নেই। আর তাছাড়া গার্মেন্ট খাতের একটা বড় অংশের নারী শ্রমিককে একলাই সংসারের বোঝা টানতে হয়। ফলে আটটা-পাঁচটা টানা পরিশ্রমের পরও তারা ওভারটাইম পেলে খুশি হয়। ঘণ্টাপ্রতি তিরিশ, চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ টাকা বেশি রোজগারের জন্য তারা সকাল আটটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্তও খাটে।
একটা প্রসঙ্গ টেনে শেষ করতে চাই। শ্রম আইন অনুযায়ী গার্মেন্ট শিল্পে গর্ভবতী নারীদের কাজের ক্ষেত্রে পরিশ্রম খানিকটা শিথিল হওয়ার কথা। অনেক কারখানায় এই আইন অনুসরণ করা হয় না, আবার অনেক কারখানায় করা হয়। সাধারণত গর্ভাবস্থার চার থেকে পাঁচ মাস পর তাদের মেশিনে না বসিয়ে অন্য হালকা কাজ করানো হয়। তাদের বিকেল পাঁচটায় ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়, কোনো ওভারটাইম করানো হয় না। কিন্তু অনেক নারী শ্রমিকই শুরুর দিকে তাদের গর্ভাবস্থার কথা কর্তৃপক্ষের কাছে লুকাতে চান, তাদের ওভারটাইম করার সুযোগ থাকবে না, এই আশংকায়। পরিস্থিতি কতটা সঙ্গিন হলে একজন নারী গর্ভাস্থায় তার প্রাপ্য বিশ্রামের সুযোগ ছেড়েও ওভারটাইম করতে চায়! এমনতর নিদারুণ বাস্তবতায় সরকারকে বিবেচক ও মানবিক হয়ে গার্মেন্ট খাতসহ জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ১৬,০০০ টাকা করার দাবি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন মনে করি।
লেখক
শ্যামলী শীল
শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৮
এমজেএফ