কয়েকদিন হলো দিল্লিতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বাড়ি ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এই সহিংসতায় প্রাণ গেছে ৪৮ জনের।
মোদীকে আসতে না দিলেই যে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমনও নয়। মাথায় রাখতে হবে, বাংলাদেশ সরকার মোদীকে আমন্ত্রণ জানায়নি, জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। মোদীকে বাধা প্রদানের পূর্বে একবার ভাবি, তুরস্কের এরদোগানকে স্বাগত জানাবেন কীভাবে? সে তো তার দেশের অসংখ্য মুসলিমকে মেরেছে। সৌদিকে স্বাগত জানাবেন কী করে! সৌদিরা বাংলাদেশের মুসলিম নারী শ্রমিকদের নিয়ে যেভাবে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে চলছে! সিরিয়া এবং ইয়েমেন সংকট সৌদি আরবের কারণে। জানেন তো নাকি? ফিলিস্তিনে মানুষের ওপর ইসরায়েলকে জায়েজ ঘোষণা করেছে সৌদি গ্রান্ড মুফতি। সেই মুফতির পেছনে বিশ্ব মুসলিম তথা বাঙালি মুসলমানরা হজ পালন করতে যাবে? নিশ্চয়ই যাবে?
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন? রাখেন, তার পূর্বে ভাবেন তো উইঘুর সংখ্যালঘু মুসলমানের মানবেতর জীবন যাপনের কথা। বর্তমান পৃথিবীতে চীনের উইঘুর মুসলমানরা সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে চীন সরকারেরই কারণে। সেখানে মুসলমানরা তাদের অধিকার নিয়ে কোনো কথা বলতে পারছেন না, অথচ আমার দেশের জনগণ একদম চুপ।
রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান? সম্প্রতি সিরিয়াতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে রাশানবাহিনী। শুধু কি তাই? না, তারা চেচনিয়া, বসনিয়ার মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করে স্তনও কেটে নিয়েছে একটা সময়। সেই রাশিয়া এখন পৃথিবীর অনেক অনেক দেশের বন্ধু রাষ্ট্র। রাশান রূপকথা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি। আবার জেগে পড়তে বসি।
ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে আসতে দিতে চান? তারা তো পুরো পৃথিবীটাকে কঠিনভাবে দমন করেছে। এক ভারতবর্ষের শত শত আলেম, মুফতি, পীর-মাশায়েকের গলায় রশি দিয়ে ফাঁসি দিয়েছে। কখনো কখনো ঝুঁলিয়ে দিয়েছে গাছের সঙ্গে। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছে। জানেন সেই রক্তে আজও তরতাজা এই ভারতবর্ষ। হত্যার প্রতিবাদে হোসাইন আহমেদ মাদানি, কাশেম নানতুবি, আবু মাসুদ রশিদ আহমেদ গাঙ্গুহী, শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসানের মতো ব্যক্তিত্বদের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উপমহাদের শ্রেষ্ঠ ভারতের দেওবন্দ উলুম মাদরাসা। আমাদের তিতুমীর, ক্ষুদিরামরা জীবন দিয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। এত মৃত্যু এত রক্তের পর আসার অনুমতি দেয়াটা অবশ্যই ঠিক হবে না। প্রশ্ন হলো- তাহলে কাকে আসতে দিতে চান বাংলাদেশে?
পাকিস্তানিদের? নাহ। তাদেরকেও তো আসতে দিতে চাইছেন না। কেনো? উত্তর নেয়ার পূর্বে বলেন তো, পৃথিবীর বুকে একবার মাত্র পারমাণবিক বোমার প্রয়োগ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। আমেরিকার সেই বোমার আঘাতে জাপানের হিরোশিমা-নাগাসিকা নামের দুইটি শহর আগ্নিকুণ্ডতে পরিণত হয়েছিলো। মারা গিয়েছিলো লাখো মানুষ। আজো সেই দুই শহরে জন্ম নেয়া নতুন বাচ্চাদের অনেকেই পারমাণবিক বোমার রয়ে যাওয়া রিয়েকশানের কারণে শারীরিক অপূর্ণতা নিয়ে জন্ম নিতে হচ্ছে। তারপরেও আজকে আমেরিকা-জাপান একে অপরের উন্নয়নের সব চাইতে কাছের মিত্র। মার্কিনদের ৩০ শতাংশের মতো ল্যান্ড জাপানিদের দখলে। ইরাক যুদ্ধে, আফগান যুদ্ধে সৈন্য দিয়ে শত্রুকে বন্ধু বানিয়েছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা চিন্তা করেন, ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে রাশিয়া সে সময়ে ভারতের সাথে এক জোট হয়েছিল। আজকে সেই পাকিস্তান-রাশিয়া একে অপরের বন্ধু রাষ্ট্র।
কে না জানে জার্মান-ফ্রান্স রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ইতিহাস বিখ্যাত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯১৮ সালে। চার বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে নিহত হন ১৪ লক্ষ ফরাসি ও ২০ লক্ষ জার্মান সৈনিক। আজকে এককালের শত্রু দুই দেশের মিত্রতার কারণে টিকে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারপরও আমরা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিকে প্রশ্রয় দেব না, দিলে সুবিধাবাদীরা চেতনা বিক্রি করে নিতে পারবে না। আবার পাকিস্তানও আমাদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধকে মেনে দুঃখ প্রকাশ করল না। আমরা পাকিস্তানিদের ক্ষমা করি না। করব না।
তাহলে কাকে আশ্রয় দিতে চান? ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশ আমেরিকাকে? হায়! হায়! আজীবন আমেরিকার চিরশত্রু মুসলিমরা। জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র পৃথিবীকে করে ফেলছে কোনঠাসা। এমন পরিস্থিতির শিকার সবচেয়ে বেশি মুসলিমরা। জানেন তো? নাকি? কিন্তু কই কেউ তো মুখ খুলে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। বরং মার্কিন ভিসা নিয়ে সে দেশের বাসিন্দা হতে সর্বহারা হচ্ছে অনেক বাঙালি মুসলমান যুবক।
আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত হামজা বেনদেলাজের কথা কারো মনে থাকতে পারে। তার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের গুরুতর অভিযোগ, হামজা মার্কিন দুই শতাধিক ব্যাংক থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার হ্যাকিং করে তা গরিব আফ্রিকান ও ফিলিস্তিনিদের দান করেছেন। এই যুবককে থাইল্যান্ড থেকে গ্রেফতার করে মার্কিন প্রশাসন। ১৫ বছরের দণ্ড দিয়ে তার ওপর করা হচ্ছে মানসিক অত্যাচার। কথা হলো, সেই মার্কিনদের সুযোগ দেয়া ঠিক হবে? মোটেই না।
তাহলে সমন্বয় করতে হবে প্রতিবেশি রাষ্ট্র মিয়ানমারের সঙ্গে? সেই সুযোগও নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুটি সেখানে বিষবাত। এখন বাঙালিকে একা থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু একা থাকার মতো কিংবা ২০ কোটি মানুষকে টেনে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা আমাদের নেই। আমাদের সরকারেরও নেই। আবার একাও থাকা যাবে না। মোদী ব্যক্তিজীবনে স্বামী বিবেকানন্দ দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর সদস্য তা আমরা জানি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ভারতের একটি ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী, আধাসামরিক ও বেসরকারি স্বেচ্ছা-সেবক সংগঠন। তারপরও এই লোকটির বিরুদ্ধে কথা বলা কতটা যৌক্তিক? তিনি তো হিন্দুদের পক্ষে কথা বলবেনই। আপনাদের কাছে অনেক যুক্তি থাকতে পারে। তাতে মোদীর কিছু যাবে আসবে না। তারপরও একটি রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। সম্পর্ক টেনে টেনে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। একটা সুন্দর পৃথিবী আগামী প্রজন্মকে উপহার দেয়ার জন্য হলেও।
নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী একজন কৌশলী রাজনীতিবিদ। তিনি এটা ভালো করে জানেন, ভারত থেকে মুসলমান তাড়িয়ে দিলে তার ও তাদের রাজনৈতিক অবস্থান জিরোতে নেমে আসবে। কারণ, তখন তারা নিজেরা নিজেদের ধর্মকে ভাগ করতে বসবে। ভাগ হবে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম, শিখ ধর্ম ও শাক্ত ধর্ম। ভাগ হবে হিন্দু ধর্মের ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র। নরেন্দ্র মোদী এতটা বোকা কিংবা আনস্মার্ট নন যে মুসলমান তাড়িয়ে শতভাগ হিন্দুরাষ্ট্র বানাবেন ভারতকে। মনে রাখবেন, ভারতের মুসলমানরা ভারতের জাতীয় রাজনীতির একটা পার্ট। সেই পার্ট স্টপ করে দেয়া মানে মোদীর রাজনীতি স্টপ হয়ে যাওয়া। বিশ্ব রাজনীতি থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
সো, আপনারা মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আসতে দিন। এতে আমাদের আভিজাত্য বাড়বে। সো, মোদীকে স্বাগত জানান। মোদীর সঙ্গে আলোচনায় বসে তাদের ইন্টারনাল সমস্যা নিয়ে বড়ো জোর পরামর্শ দিতে পারেন। কথা বলতে পারেন। আমরা তাদের কাজ কর্ম সম্পর্কে অবহিত এটা জানাতে পারেন। কিন্তু, কাউকে আটকিয়ে কিংবা আলোচনায় না বসে পৃথিবীতে খুব কম সমস্যার সমাধান হয়েছে। যার বাস্তব প্রমাণ বাংলাদেশের রাজনীতি। নরেন্দ্র মোদী আমার অপছন্দের রাজনীতিবিদ হলেও তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি না চাইলে স্থানীয় সংখ্যালঘু মুসলিমদের সমস্যার সমাধান হবে না। হবে না। হবে না। ভারত অসুখী হলে যে আমরা সুবিধায় থাকব তেমনটিও না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীকে স্বাগতম।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক।